৯. বিস্ময় নাকি বিভীষিকা
দশ মিনিট ধরে নাকের ওপর বরফের পুঁটুলি ধরে রাখতে তবে মিন হুয়ের নাক থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হলো। মিন হুয়ের বাড়াবাড়ি রকমের অ্যালার্জিক রাইনাইটিস আছে। তার নাক থেকে রক্ত বেরোতে পারে যদি তার শরীর খুব শুকিয়ে যায় বা সে যদি খুব রেগে যায় অথবা তার যদি ঠান্ডা লাগে কিংবা সে যদি উদ্বেগে থাকে। এই জন্যই সে সাঁতার কাটতে পারে না। প্রথম ছ বছর বয়সে ও সাঁতার কাঁটে যখন ওর মা ওকে একটা শহরের একটা ওয়াটার অ্যামিউসমেন্ট পার্কে নিয়ে গিয়ে ছিলেন তখন। কোনো ধারণা ছিলো না ওর বা ওর মায়ের যে সাঁতার কাটলে নাক থেকে রক্ত পড়তে পারে। কিন্তু জলে নামতেই মিন হুয়ের নাক থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে। চারপাশের বাচ্চারা, তাদের মা-বাবারা মিন হুয়েকে সমানে ঘিরে ধরতে থাকে যদিও কারুরই কোনো ধারণা ছিলো না যে কেনো মিন হুয়ের নাক থেকে রক্ত পড়ছে। আবার পরক্ষণেই সব পড়ি কি মরি করে পুল থেকে উঠে পড়তে থাকে এই ভয়ে যে রক্ত থেকে যদি কোনো সংক্রামক অসুখ ছড়ায়। পার্কের কর্মীরা দৌড়ে এসে দেখেন যে জল তার মধ্যেই লাল হয়ে গেছে। তাদের আশঙ্কা জেগে উঠলো সংক্রমণের। তারা সচকিত হয়ে পড়লো যে কোনো ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপে রক্ত বেরোচ্ছে কিনা। তারা ধড়ফড় করে এলাকাটা থেকে মানুষজনকে বার করে দিতে লাগলো। তারপর পুলের সব জল বার করে দিলো। পুলটা তারা খোলেই নি যতো দিন না যথাযথভাবে রোগ জীবাণু ধ্বংস করার ব্যবস্থা হয়ে ছিলো।
অসুখের জেরে মিন হুয়ের আর সাঁতার কাটা হয় নি।
মিন হুয়ের মাথাটা হাতে ধরে শিন ছি বললো, “এই প্রথম আমি তোকে এরকম দেখছি।”
যত্নের নিষেধ করলো, “চোখ তুলিস না। টাকরায় রক্ত লেগে বিষম খাবি। অল্প সামনে ঝোঁক।”
মিন হুয়ে সামনে ঝুঁকতে থাকে। যে মূহুর্তে ঝোঁকাটা ঠিকঠাক হয়েছে মনে করে শিন ছি, সেই মূহুর্তে জানায়, “ব্যস, ঠিক আছে।”
তারপর পরামর্শ দেয়, “তুই নিজেই এইখানটা চেপে ধর। বেশি চাপ দিস না যেনো।”
শিন ছির কথা শেষ হতে মিন হুয়ে দৌড়ে গেলো চানঘরে, তুলোর গোলা আছে কিনা দেখতে। তুলোর গোলাকে সলতের মতো পাকিয়ে দু নাকে গুঁজে দিলো মিন হুয়ে। তারপর একটা তোয়ালে জলে ভিজিয়ে কপালের ওপর থাবড়ে থাবড়ে ঠান্ডা সেঁক দিতে থাকে। মিনিট দশেক পরে রক্ত বন্ধ হয়ে যায়।
মার্বেলের সাদা মেঝেতে লাল রক্তের একটা পুকুর হয়ে গেছে, যেনো খুনখারাপি কিছু একটা হয়েছে। মিন হুয়ের গায়ের জামাও রক্তারক্তি। বিব্রত মিন হুয়ে তাড়াহুড়ো করে বললো, “আমি জামাটা বদলে নিচ্ছি।”
শিন ছি এমন করে মিন হুয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো যেনো সাংঘাতিক কিছু একটা হয়েছে। বছরে তিন থেকে পাঁচবার এমন রক্তারক্তি কান্ড মিন হুয়ের জীবনে ঘটেই থাকে। সে অভ্যস্ত এই ব্যাপারটাতে। মিন হুয়ে ঘাড় নেড়ে আশ্বস্ত করলো যে সব ঠিক আছে।
শিন ছির মুখে দূর্ভাবনার ছাপ দেখে মিন হুয়ের মনটা একটু নরম হলো। বসলো গিয়ে বসার ঘরের সোফায়। মিন হুয়ের বাঁ হাতের অনামিকায় চিমটি দিয়ে শিন ছি বললো, “হাতটা দে, ডলে দি।”
আঙুলের গোড়া থেকে ওপরের দিকে কয়েকবার ডলে দিয়ে বললো, “এখানে একটা স্নায়ু আছে। ফুসফুসের সাথে জোড়া। এভাবে ডলে দিলে বেশ কাজেও দেয়।”
মিন হুয়ে জানতে চায়, “কতো ক্ষণ?”
শিন ছি জবাব দেয়, “একশো বার।”
বলতে থাকে, “তবে খুব বেশি জোর দেবার দরকার নেই। তবে আঙুল লাল হয়ে যাওয়া পর্যন্ত ডলে যাওয়া ভালো।”
কথা বলতে বলতেই শিন ছির হাত ডলে দিচ্ছিলো মিন হুয়ের স্নায়ু বেশ চাপ দিতে দিতে। মিন হুয়ের কান লাল হয়ে উঠলো শিন ছির কথা শুনতে শুনতে।
যখন মিন হুয়ের বাবা মারা গিয়ে ছিলেন, তখন মিন হুয়ের বয়স খুব কম। জীবনে কখনো কোনো পুরুষের হাতের যত্ন মিন হুয়ে পায় নি। মিন হুয়ের অস্বস্তি লাগছে। এটা আশিস নয়। মিন হুয়ের লজ্জা করছে এই যত্ন নিতে। হাতটা টেনে সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে বার বার। আবার এটাও মনে হচ্ছে যে হাতটা টেনে সরিয়ে নিলে তাতে শিন ছির যত্নকে অসম্মান করা হবে। কোনো রকমে হাসতে হাসতে মিন হুয়ে বললো, “তুই এটা কেনো করছিস? এটা একটা চলতি চিনে ম্যাসাজ। এতো আমিও নিজে করে নিতে পারি।”
সুযোগ মতো মিন হুয়ে নিজের হাত টেনে সরিয়ে নিলো আর নিজেই নিজেকে ম্যাসাজ দিতে লাগলো। শিন ছি জানালো, “ছোটোবেলায় অনেকবার হাসপাতালে গেছি তো। দীর্ঘ অসুখে ভুগে ভুগে আমিও খানিক ডাক্তার হয়ে গেছি। হাই স্কুল পাশ করার পরে আমি বাচ্চাদের হাসপাতালে ভলান্টিয়ার করেছি।”
মিন হুয়ের মনে প্রশ্ন জাগেঃ তার মানে শিন ছি পেশায় ডাক্তার?
মিন হুয়ের মনে হতো যে মানুষ বিচারের ক্ষমতা তার খুব খারাপ নয়, কিন্তু কয়েক বার তার মারাত্মক ভুলও হয়েছে। সে খেয়াল করে দেখলো যে শিন ছির পেশা সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই নেই। কী ধরনের কাজ শিন ছি করতে পারে - ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞান নাকি লিবারেল আর্টস? আবেগের বহুমুখিতা আর ভাষার বৈচিত্র্য থেকে মনে হচ্ছে লিবারেল আর্টসই হবে।
শিন ছির হাত দুটো সুন্দর, দশটা আঙুলই সরু, গাঁটগুলো স্পষ্ট, নখ পরিস্কার। কোনো কড়া পড়ার দাগ নেই। নিশ্চিত শিন ছি গতর খেটে খাবার কাজ করে না সু তিয়াঁর মতো।
অর্থনৈতিক অবস্থাতেও দারিদ্র্যের ছাপ নেই।
প্রথমত, হিরের আংটি। এক কারাটের বেশি। বিশ-তিরিশ হাজার ডলার দাম হবে।
তারপর হানিমুন ভিলা। মিন হুয়ে সি ট্রিপে দেখেছে। এলাকাটা দূর্গম হলেও, চারপাশের দৃশ্য সুন্দর, অনেকটা জায়গা নিয়ে, সঙ্গে একটা ব্যক্তিগত ব্যবহারের পুল আছে। সব থেকে সস্তাটাও প্রতিরাতে আট হাজার য়ুঁয়াঁ।
কেউ নিউইয়র্কে আছে জানা থাকলে আর মুভিতে নিউইয়র্ক দেখে থাকলে নিশ্চিত জানে যে নিউইয়র্কে বাড়ির খরচা মোটেই কম নয়।
আবার উল্টোদিকে, শিন ছির জামাকাপড় আর খাওয়াদাওয়া বেশ সাধারণ। তাতে কোনো নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য নেই। জামাকাপড়গুলো মূলত সাদা, কালো আর ধূসর, মূলত খেলাধূলোর জামা। কোনো বড়ো ব্র্যান্ডের নয়। কম্পিউটার, ফোন, ঘড়ি সবই অ্যাপল সিরিজ। ওগুলো চার্জেই দেওয়া আছে কফি টেবিলের ওপরে যতো ক্ষণ মিন হুয়ে ঘরে ঢুকেছে ততো ক্ষণ, আর ওগুলোকে খুব ব্যবহারও করে নি শিন ছি।
মিন হুয়ের মনে হচ্ছিলো যে শিন ছি যেনো একটা ধাঁধাঁ। এতো স্ববিরোধ ! বিশেষতঃ মিন হুয়ের সামনের যে শিন ছি আছে সেই শিন ছি আর সু তিয়াঁর ডায়েরির শিন ছি - ভীষণ আলাদা। শিন ছি যখন বন্ধু তখন সে যেনো পড়শী, পাড়াতুতো দাদা। শিন ছি যখন গম্ভীর তখন যেনো সে এক মহা প্রভাবশালী প্রাতিষ্ঠানিক প্রধান। যখন শিন ছি দুষ্টু তখন তার চাল হালকা আর কৌতুকময়। যখন শিন ছি চুপচাপ তখন তাকে দেখলে ভয় লাগে, তখন শিন ছি প্রলোভনের প্রভু। ভালোবাসলে শিন ছি প্রতিজ্ঞা করে, প্রতিশ্রুতি রাখে, আর ঘেন্না করলে শিন ছি খুনও করতে পারে।
শিন ছি মজাদার, কিন্তু পরিমিতির মধ্যে, সীমা ছুঁয়ে ফেললেও, জোর করে সীমা লঙ্ঘন করে না।
মিন হুয়ে অনেক ক্ষণ ধরে ভাবলো। কিন্তু কিছুতেই শিন ছি পয়সা রোজগার যে কী কাজ করে তা ঠাহর করে উঠতে পারলো না। তারপর আবার সে নিজের ভেতরে গুটিয়ে যেতে শুরু করলো। সে জানে না যে সামনের কয়েকটা দিন কেমনভাবে কাটবে। সে কিন্তু কিছুতেই তার লুকিয়ে রাখা সত্যিটা প্রকাশ করতে পারবে না। তার কোনো উপায় নেই আর নিজের দাঁত কিড়মিড়িয়ে নিজেকে উৎসাহিত করা ছাড়া, ‘যতো ক্ষণ না এরকম একটা লোক তার সাথে কোনো লেনদেনে আসছে, তার আইকিউ-এর সাথে আর তেরো বছরের বিচ্ছেদের বহু তথ্যশূণ্যতার সাথে, ততো ক্ষণ সে চালিয়ে নিতে পারবে।’
সবথেকে জটিল ব্যাপার হলো যে তার পিঠ যেনো দেয়ালে ঠেকে গেছে। সে যদি মন দিয়ে সু তিয়াঁ হয়ে না ওঠে, তাহলে তাকে অনেক চেষ্টা করতে হবে আসল কথাটা লুকোনোর জন্য। অন্যদিকে মন দিয়ে সু তিয়াঁ হয়ে ওঠাটা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি।
আসল সু তিয়াঁ আর মিন হুয়ে অবতারে সু তিয়াঁ অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছে। এদিকে শিন ছির সুচারু আচরণে সে অনেক আগেই এই নাটকের গভীরে ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যেই তার পালাবার পথটা বন্ধ হয়ে গেছে।
মিংশুই শিয়াহ্ পড়ে হারবিন আর সুইহুয়ার মধ্যে। হোটেল হারবিনে যাবার সকালের ট্রেন বুক করে দিয়েছে মিন হুয়ে আর শিন ছির জন্য।
মিন হুয়ে দক্ষিণের লোক। ইয়াংছেনজেনের আগে সব চেয়ে উত্তরে ও যা দেখে ছিলো তা বেজিং। উত্তরপুবের তিনটে প্রদেশের কোন জায়গার যে কি নাম সে সম্বন্ধে ওর বিশেষ ধারণা নেই।
শিন ছি বলছিলো যে সুইহুয়া খুব দূরে নয়। কিন্তু আসলে জায়গাটা খুব কাছেও নয়। প্রথমে চারঘন্টা ট্রেনে যেতে হয়, তারপরে চারঘন্টা বাসে যেতে হয়।
শিন ছির সাথে একটানা আটঘন্টা বাস আর ট্রেনের মতো বদ্ধ জায়গায় কাটাতে হবে এ কথা ভেবেই মিন হুয়ের দমবন্ধ হয়ে আসছে। যেনো পালাবার কোনো উপায় নেই।
কপাল জোরে ট্রেনে ওঠা মাত্র এক দল কলেজ ছাত্র বগিতে বসে আছে দেখা গেলো। তাদের সবার হাতে একটা করে শপিং ব্যাগ। ব্যাগের গায়ে লেখা আছে, ‘ইয়ে য়ুয়া হ্রদ প্রাকৃতিক অঞ্চল’। হয়তো এই দলটাও, মিন হুয়ে আর শিন ছির মতো ইয়ে য়ুয়া হ্রদ প্রাকৃতিক অঞ্চলে বেড়াতে গিয়ে ছিলো।
কলেজ ছাত্রদের মধ্যে দুটো ছেলের উল্টো মিন হুয়ে আর শিন ছির বসার জায়গা। একটা ছেলের নাম তাং। লম্বা আর সুদর্শন। পরণে পাতলা টিশার্ট, ফুটে আছে তার শরীরের কারুকাজ। দেখে মনে হচ্ছিলো যে স্পোর্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে। অন্য ছেলেটার নাম ছিয়াঁ, একই ক্লাসে পড়ে তাং-এর সাথে। এই ছেলেটাও মাথায় মাঝারি লম্বা। একটু গোলগাল। কালো ফ্রেমের চশমা পরা।
মিন হুয়ে আর শিন ছিকে উল্টোদিকের বসতে দেখে ছেলেদুটো তাস বার করলো পোকার খেলার জন্য। জানতে চাইলো যে আপগ্রেড খেলবে কিনা মিন হুয়ে আর শিন ছি। মিন হুয়ে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলো। ইয়াংছেনজেন থেকে হারবিন চার ঘন্টা কাটাতে হবে। পোকার খেলে নষ্ট করার থেকে ভালো আর কি বা হতে পারে?
শিন ছি বেঁকে বসলো, “না আমি খেলবো না। আমি কখনো আপগ্রেড খেলি নি।”
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “ব্রিজ?”
শিন ছি বললো, “ব্রিজ ক্লাব।”
মিন হুয়ে বললো, “আপগ্রেড খেলা খুব সহজ। আমি তোকে শিখিয়ে দিচ্ছি ……”
মিন হুয়ে বাক্স থেকে দুটো তাস বার করে বললো, “এই যে শিখে নে …… তুই শেখামাত্র খেলতে পারবি, যখনই খেলতে শুরু করবি, খেলতে পারবি।”
ছেলে দুটো একটু অখুশি হলো এই দেখে যে শিন ছি খেলতে পারে না আর সবে শিখতে চাইছে খেলাটা। ওরা বললো যে শিন ছি যদি পিছনের সিটের ছেলেটার সাথে জায়গা বদল করে নেয়, তাহলে ওরা শুধু মিন হুয়ের সাথেই খেলতে পারে।
শিন ছি আপত্তি করলো, “না, আমি তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারি।”
মিন হুয়ে মিনিট দশেকে শিন ছিকে খেলার নিয়মগুলো সব বলে দিলো আর বুঝিয়ে দিলো যে কেমন ভাবে খেলাটা হয়। তারপর দুজনে জোড় বেধে ছেলেদুটোর সাথে খেলতে লাগলো। তাং নামের ছেলেটা বড্ডো কথা বলে।
মিন হুয়ে দেখতে সুন্দর, চেহারাও ভালো। তাং কিছুতেই থেকে থেকে মিন হুয়ের দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারছে না। নানা ছুতোয় মিন হুয়ের কাছে আসার চেষ্টা করছে। মিন হুয়ে বেড়ে উঠে ছিলো তাড়াতাড়ি। জুনিয়র হাইস্কুল থেকেই ছেলেরা ওকে ধাওয়া করে। সবে যখন মিন হুয়ে আর শিন ছি ছয় ছুয়েঁছে, ততোক্ষণে কলেজের ছেলেরা গোলাম ধরে ফেলেছে।
কিন্তু শিন ছি তাড়াতাড়ি শিখে নিয়েছে। ভেবেচিন্তে খেলছে। ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগলো না। মাত্র দেড়ঘন্টা লাগলো টেক্কায় পৌঁছোতে। কলেজের ছেলেরা মানতে রাজি হলো না। তাই ফিরে খেলা শুরু হলো।
খানিক পরে শিন ছি একটা হরতনের বিবি কে উড়ো তাস হিসেবে খেলল। সেটা দেখে মিন হুয়ে বুঝে গেলো যে শিন ছির হাতে একটা মাত্র হরতনের সাহেব আছে। মিন হুয়ের নিজের হাতে হরতনের টেক্কা আর গোলাম। ব্যাপারটা চাপা রেখে দশটা হরতন খেলিয়ে দিলো। শিন ছি একঝলক দেখলো মিন হুয়ের দিকে, হাসলো আর মিন হুয়েকে ধন্যবাদ জানালো।
আসলে মিন হুয়ে তো শুরুর থেকেই শিন ছির খেলা সব তাসের চুলচেরা বিচার করছে, হিসেব করছে, কেবল নিজের হাতের তাস খেলে না গিয়ে। মিন হুয়ে ভাবছে বলেই, শিন ছিও খুব শিগগির ব্যাপারখানা বুঝে গেলো। সব সময়ে ও সেই তাসটাই খেলছে যেটা মিন হুয়ে চাইছে। এমনকি একটু ঝামেলার সময়েও দুজনের বোঝাপড়াটা নাড়া খায় নি। দুজনে চুপচাপ একে অপরের দানে সঙ্গত করে চলেছে। খুব শিগগির তারা দ্বিতীয় খেলাটাও জিতে গেলো।
তাং নামের ছেলেটা মিন হুয়ের তাস খেলার ওস্তাদিতে মুগ্ধ, “জিয়েজিয়ে আপনি তো দূর্দান্ত।”
তারপর গদগদ হয়ে বলেই চলে, “আপনি নিশ্চয়ই বিজ্ঞান কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন, তাই না? অঙ্কে ভীষণ ভালো, ঠিক কিনা? আমার অনুমান আপনি হারবিন ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়েন। নিদেন পক্ষে স্নাতোকোত্তর ছাত্র? আমরা সবাই মেকানিক্যাল আর ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ছাত্র এখানে। জিয়েজিয়ে, আপনি কী এখন কাজ করেন নাকি এখনো পড়াশোনা করেন? আপনিও কী হারবিনে থাকেন? আসুন উই চাটে যোগাযোগ করি। আপনার যখন ইচ্ছে তখনই আপনি আমাদের স্কুলে খেলতে আসতে পারেন। সবাই-ই একে অপরের থেকে কিছু না কিছু শেখার সুযোগ পাবে।”
এই এতো প্রশ্নের কোনো একটার উত্তর সব গোপণীয়তার পর্দা ফাঁস করে দেবে। মিন হুয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে হাসলো, “কলেজে যাওয়া হয় তাস খেলতে? যতো খেলবে ততো ওস্তাদ হবে।”
তাং নামের ছেলেটা মোবাইল ফোন বার করতে করতে বললো, “আমাদের কলেজে বেশিরভাগ মেয়েই তাস খেলে না।”
মিন হুয়ে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে দেখে ছেলেটা মিন হুয়ের বুকের ওপর চোখ বুলিয়ে নিলো, চোখের কোণ দিয়ে। তার সঙ্গী শুধরে দিলো, “তার কারণ আমাদের ইউনিভার্সিটিতে মেয়ের সংখ্যা কম।”
মিন হুয়ে চোখ ফিরিয়ে বললো, “আমার স্মৃতিটা পোক্ত, শক্তিশালী। আমি তাস মনে রাখতে পারি আর পয়েন্টও গুনতে পারি।”
চোখ ফেরানোর সময় মিন হুয়ে চোখ পড়লো তাং-এর চোখে, তাং-এর দৃষ্টি অনুসরণ করে মিন হুয়ে দেখলো যে কোনো এক সময়ে তার জামার বুকের ওপরের একটা বোতাম কিভাবে যেনো খুলে গেছে। বোতামটা আবার লাগিয়ে নেওয়া সহজ নয়। সেই জন্য ও ভান করতে লাগলো এমন যাতে জলের গেলাসটা ধরে আছে বলে মনে হয়, আর এই ভঙ্গিমাতে ওর হাত এমন ছড়িয়ে আছে যাতে বুকের ওপরের খোলা বোতামের অংশটা ঢাকা পড়ে।
ছেলেটা জোর করে, হংকং-এর উচ্চারণে, প্রায় স্টিফেন চো-এর কায়দায় বললো, “কী বিনয়ী! জিয়ে, আপনি তো জিনিয়াস!”
মিন হুয়ে হতাশ হচ্ছে। সারাক্ষণ তার কেনো যেনো মনে হচ্ছে শ্লীলতার সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে সব কিছু। কিন্তু সে কোনো ঝামেলা চায় না। তাই সে একটু হাসলো।
মিন হুয়ে কিচ্ছু বলছে না দেখে ছেলেটা আরো বললো, “জিয়ে জিয়ে, আমাকে শেখান না? আপনার ছাত্র করে নিন না!”
এবার সে শিন ছির দিকে ফিরে বললো, “গ্যগ্য, আপনি কী ওঁর প্রেমিক? আমাকে বলুন না?”
শিন ছি কিছু বললো না। হাতের মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে এক চুমুক জল খেলো মাত্র। তারপর মাথাটা তুলে হালকা চোখে তাং-কে দেখতে দেখতে বললো, “আমাকে গ্যগ্য বলতে হবে না। বরং আমাকে ‘জিয়েফু’ বলুন। আপনার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে, একঘেয়েমি কাটাতে তাস খেলেছি। ওর উইচ্যাট নেই। ও ছাত্রও ভর্তি করে না।”
শিন ছির মুখটা সুবিধের নয় দেখে আর শিন ছির চেহারার জন্যও হয়তো তাং নামের ছেলেটা শিন ছিকে পাশ কাটিয়ে মিন হুয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো। মোবাইলটা বার করে উইচ্যাট খুলে বললো, “জিয়েজিয়ে কোডটা স্ক্যান করুন না ……”
মিন হুয়ে বললো, “সত্যিই আমার উইচ্যাট নেই।”
তাং তর্ক জুড়লো “জিয়েজিয়ে, তুমি কী কবরে গিয়ে খবরের কাগজ পড়ো? মিথ্যে বলছো তো? আজকের দিনে উইচ্যাট নেই কার?”
শিন ছি হঠাৎ ছেলেটার মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে টেবিলের ওপরে রাখলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা স্বরে বললো, “ও তো বলছে ওর উইচ্যাট নেই।”
তাং-ও উঠে দাঁড়ালো, “গগ, আমি কী আপনার সাথে কথা বলেছি?”
হঠাতই ছেলেটা শিন ছির তুলনায় আধমাথা লম্বা হয়ে গেলো। বুকের ওপরে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত। উস্কানি দিয়ে বললো, “দুই পোকার বন্ধুর মধ্যে পোকারের কায়দা লেনদেন হলে অসুবিধে কী? কোন সময়ে আমরা বাস করছি যে আমার জিয়েজিয়ে চাইছে যে আপনি তার হয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন? আমি তো দেখছি -”
বুম - শিন ছি ডান হাতে কষিয়ে দিলো এক ঘুঁষি।
আপারকাট, গিয়ে সোজা পড়লো ছেলেটার নাকের হাড়ে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো তক্ষুনি।
বন্ধু মার খেয়েছে দেখে, ছিয়াঁ নামের অন্য ছেলেটা মোটেই খুশি হলো না। সে জলের গ্লাসটা বাগিয়ে ধরে ছুঁড়ে দিলো শিন ছির মাথায় টিপ করে। যতো ক্ষণে শিন ছি সেটা দেখতে পেলো, ততো ক্ষণে মাল রাখার তাকে গোঁত্তা খেয়ে গ্লাসটা কয়েক টুকরো হয়ে ভেঙে গেলো। কাঁচের টুকরোগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। কিছু পড়লো শিন ছির মুখেও। আঁচড়ে গেলো শিন ছির মুখ, দুটো স্পষ্ট রক্তের ধারা নামতে লাগলো।
শিন ছিকে জাপটে ধরে ওর মুখে একটা ঘুষি কষাতে কষাতে তাং বললো, “নিকুচি করেছে। তোর এতো সাহস তুই আমাকে মারলি?”
শিন ছি এর মধ্যেই তাং-এর মুখে আরেক ঘুষি কষিয়ে দিয়েছে। তাং চেঁচাতে লাগলো, “শও সি, শও দিঁ, আয়, আমার সঙ্গে হাত লাগা, এই লোকটাকে পেটাতে হবে!”
ডাকটা শুনেই আশে পাশে যেখানে যতো ছাত্র বসে ছিলো সব দৌড়ে এসে শিন ছি আর তাং-এর চারপাশে জড়ো হয়ে গেলো। দু দল লোক তৈরি যেনো মারপিট করার জন্য। মিন হুয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “দাঁড়া। ফের কিছু বললে আমাকে, আমি কিন্তু পুলিশ ডাকবো।”
শিন ছির পাশে বসা যাত্রী শিন ছিকে টেনে সরাতে গেলো। শিন ছি কিছুতেই ছাড়বে না। মিন হুয়ে টানতে টানতে শিন ছিকে নিয়ে গেলো বগির দরজার কাছে, “শিন ছি, মারপিট বন্ধ কর। আমাদের স্টেশন এক্ষুণি এসে যাবে। মালপত্র গুছিয়ে নে। এখানেই দাঁড়া। একদম নড়বি না।”
শিন ছি তখনও রাগে গমগম করছে, “এখন কি কলেজের ছাত্ররা জানে না যে পাঁচজনের মধ্যে থাকার সময় শান্তি কী করে রাখতে হয়? সদাচরণ কাকে বলে? না, না। আমি ওদের দেখাচ্ছি, শেখাচ্ছি।”
কথা শেষ করেই শিন ছি দৌড়ে আবার মারপিটের মধ্যে যেতে গেলো। ওকে জোর করে চেপে ধরে রাখলো মিন হুয়ে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মিন হুয়ে ঘাবড়ে গেলো, “শিন ছি, তোর ঠোঁট …… হালকা বেগুনি হয়ে গেছে। তুই ঠিক আছিস?”
শিন ছি আশ্বস্ত করলো, “ঠিক আছি।”
তারপর ঘাড় কাত করে রাখলো যাতে মিন হুয়ে ওর মুখটা আর দেখতে না পায়।
মিন হুয়ে শিন ছির হাত জড়িয়ে ধরে বললো, “তাই কী? তাহলে আর কথা বলিস না। একটু শান্ত হ।”
শিন ছির হৃদস্পন্দনের বেগ দ্রুত, শ্বাসও পড়ছিলো ঘন ঘন। দুজনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ খানিকক্ষণ পরে শিন ছির ঠোঁটের রং স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
বড়ো বড়ো চোখে মিন হুয়ে তাকালো শিন ছির দিকে। একটা নিশ্চিন্তির শ্বাস ফেলে বললো, “এখন সব ঠিক আছে।”
এই মূহুর্তেই শিন ছির পিঠে হাত পড়তে মিন হুয়ে টের পেলো যে, শিন ছির জামাটা ভিজে শপশপ করছে, যেনো কেউ বালতি বালতি জল ঢেলেছে ওর পিঠে। সেই মূহুর্তেই ভয়ে মিন হুয়ের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো। সারা গায়ে তার জেগে উঠলো শীতল ঘামের কণা।
টের পেয়ে শিন ছি একটা গভীর আলিঙ্গনে বাধলো মিন হুয়েকে। বললো, “দুশ্চিন্তা করিস না। আমি ঠিক হয়ে যাবো।”
এমন সময় ট্রেনটা আস্তে আস্তে থেমে গেলো। তখনও মিন হুয়ে আতঙ্কে আছে দেখে শিন ছি হাসলো আর বললো, “আমি তোকে তেরো বছর দেখি নি। তুই এখন দাবা আর তাস দুটোই খেলতে পারিস, তুখোড়। আমি অবাক হচ্ছি আর ভাবছি আর কি চমক আছে তোর যা আমি এখনো জানি না?”
মিন হুয়ের কথারা সব হারিয়ে গেলো। বিস্ময়ও গেলো। যা রয়ে গেলো তা শুধু বিভীষিকা।
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-08.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-10.html
No comments:
Post a Comment