১০. ভাই
শেষ পর্যন্ত মিংশুই শিয়াহ্ পৌঁছোতে সন্ধে সাতটা পনেরো হয়ে গেলো। গাড়ির থেকে নেমেই ফোন করলো তং তিয়াঁ হাইকে। সম্ভাব্য পরিবারের এই মানুষটাই সু তিয়াঁর ভাইয়ের খবর দিতে পারে। তং তিয়াঁ হাই জানালো যে সে রাত নটার পরে খালি হবে। রাত নটা দশে সে নিজের বাসায় আসতে বললো মিন হুয়ে আর শিন ছিকে কথা বলার জন্য।
যাত্রীর নামা ওঠার জায়গাটা থেকে বেরিয়ে মিন হুয়ে নজর করলো যে জায়গাটা একটা ফাঁকা শহর, শিয়াহ্র মধ্যে। এবড়ো-খেবড়ো রাস্তার দুদিকেই গাড়ি চলছে। কোনো ট্রাফিক লাইন নেই। উল্টোদিকে কয়েকটা ঝুপড়ি দোকান। ফল আর আনাজ বেচছে। বেচছে জলখাবার, চটজলদি খাবার, হার্ডওয়্যার আর কি বা কি নয়। ছতলা হোটেলগুলোর একটার বাইরের দেয়ালের রং হলুদ। ডানদিকে, বাঁদিকে ছড়িয়ে আছে ব্যবসার বাড়ি, আপিসবাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে যে জায়গাটা খুব হালে গজিয়ে উঠেছে। চারপাশে কোথাও সবুজের ছিটেফোঁটা নেই। বেশ কিছু বাড়ি এখনো তৈরি হচ্ছে। ইঁটের দেয়ালের বাইরের গায়ে সিমেন্টের পলেস্তারা সবটা লাগানো হয় নি এখনো। মাটিতেই গাদা হয়ে পড়ে বালি, সিমেন্ট আর সব ইমারতী জোগান।
দেখা করার আগে দু ঘন্টা সময় হাতে আছে। মালপত্র দুঘন্টা ধরে এখানে সেখানে বয়ে বেড়ানোর মানে হয় না। মিন হুয়ে রাস্তার উল্টোদিকের হোটেল দেখিয়ে বললো, “চল, ওখানে আজ রাতটা কাটানোর ব্যবস্থা করি। আগে মালগুলো রাখি ওখানে।”
সু তিয়াঁ আর মিন হুয়ে দুজনের কেউই খুব সবিধে নিতে রাজি নয় আর মোটেই আশা করে না যে শিন ছি সব খরচ বইবে। পাহাড়ের মাথার ভিলা ভাড়া করার ক্ষমতা না থাকলেও, একটা ছোটো শিয়াহ্তে হোটেলের একটা ঘর নেবার সামর্থ্য নিশ্চয়ই আছে। আবার মিন হুয়ে এও চায় না যে শিন ছি খুব খারাপ ব্যবস্থার মধ্যে থাকুক। লি চুন মিয়াও বা সু তিয়াঁ মিন হুয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছে। মিন হুয়ের ত্রাতা সে। মিন হুয়ে আপ্যায়ন করছে সু তিয়াঁর বন্ধুর, একথা কিছুতেই মিন হুয়ে ভুলতে পারবে না। হোটেলটা সত্যিই খুব সুবিধের, মাত্র তিরিশ পা দূরে বাসস্টপ থেকে। কিন্তু তার চেহারাটা খুব সাদামাঠা। বাইরে একটা ভালো গেট পর্যন্ত নেই, ভেতরটা যে খুব চকচকে হবে তেমন আশা করা যায় না। তাই মিন হুয়ে ঝট করে মোবাইল ফোন বার করলো আর শিন ছিকে বললো, “দাঁড়া, দাঁড়া। হোটেলটার রেটিং কেমন দেখে নি আগে।”
মিন হুয়ে যেই সিট্রিপে ক্লিক করতে গেলো, অমনি শিন ছি মিন হুয়ের ফোনটা নামিয়ে দিয়ে বললো, “তুই সত্যিই এই হোটেলটাতে থাকতে চাস? আমি কাল রাতে একটা হোটেল বুক করেছি। হোটেলটা এখান থেকে একটু দূরে বটে, কিন্তু রিভিউ দেখে মনে হলো চলে যাবে। নিশ্চয়ই, তুই যদি জোর করিস …… তবে আমি ঐ হোটেলটা থেকে বুকিং ফি ফেরত চাইতে পারি, মানে ওদেরকে বুকিং-এর ফি দেওয়া হয়ে গেছে তো …।”
মিন হুয়ে বললো, “তাহলে ঐ হোটেলে থাক, যেটা তুই বুক করেছিস। তোর কি ট্যাক্সি লাগবে?”
কথা শেষ হবার আগেই একটা খাকি রঙের ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। ড্রাইভার মাথা বার করে বললো, “শিন জঁ, যিনি বিজনেস হোটেলে থাকবেন?”
শিন ছি জবাবে প্রশ্ন করলো, “শেন ঝু?”
ড্রাইভার বললো, “হ্যাঁ, বটে।”
শিন ছি লাইসেন্স প্লেটটা দেখলো। ড্রাইভার তক্ষুণি গাড়ির থেকে নেমে এসে দুজনের মালপত্র গাড়ির ট্রাঙ্কে তুলে নিলো।
এক মূহুর্তের মধ্যে মিন হুয়ে জমে পাথর হয়ে গেলো, “তুই ট্যাক্সি ডাকলি কখন?”
শিন ছি জানালো, “কাল রাতে হোটেল বুক করার পরে। গাড়িটাই পুরো বুক করে রেখেছি। এখানে আমরা যখন যেখানে যাবো, এই গাড়িতেই যাবো।
তারপর গাড়ির দরজা খুলে বললো, “উঠে বস।”
দুজনে গাড়ির মধ্যে বসতে নিজেকে মিন হুয়ের খুব খাটো মনে হতে লাগলো। বললো, “এখানে তো ডাকলেই ট্যাক্সি পাওয়া যায়। ভাড়া নেবার কী দরকার? অনেক খরচ তো।”
শিন ছি যুক্তি সাজালো, “প্রথমত, এটা বেজিং নয়। এখানে অনেক ট্যাক্সি নেই। দ্বিতীয়ত, তং তিয়াঁ হাই যেখানে থাকে সেই জায়গাটা অজ পাড়াগাঁ প্রায়। সেখানে যাবার জন্য ট্যাক্সি পাওয়া ভার। এলাকাটা খুব সুবিধের নয়, গুন্ডা বদমাসে ভরা। একটা গাড়ি থাকা সবসময়ে সুবিধে জনক।”
মিন হুয়ে খানিক ভাবলো। তারপর জানতে চাইলো, “তুই জানলি কী করে যে জায়গাটা অজ পাড়াগাঁ? তুই কী আগে ওখানে গেছিস কখনো?”
শিন ছি বললো, “আমি ম্যাপে দেখেছি। ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলেছি।”
মিন হুয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, “আর কী ব্যবস্থা করে রেখেছিস? তোর পাশে তো আমার নিজেকে একটা দোকানদার বলে মনে হচ্ছে।”
শিন ছি ঠাট্টা করলো, “বুদ্ধিমান মেয়েরা এসব তুচ্ছ ব্যাপারে মাথা ব্যাথা করে না। তারা এসব ব্যাপার আমাদের মতো অগোছালো ছেলেদের ওপর ছেড়ে দেয়।”
মিন হুয়ে হেসে ফেললো, “ফ্”
হোটেলে লাগেজ রেখে কাছাকাছি কোথাও রাতের খাওয়া সেরে নেওয়া যাবে এটাই ঠিক হলো। শিন ছির ব্যবস্থা হলো যে কাছাকাছি একটা টিহাউসে গিয়ে আয়রেঁঝুয়াঁ দেখা। এটা অবশ্য ট্যাক্সি ড্রাইভারের উপরোধ ছিলো।
টিহাউস বেশ জমজমাট। দুজনকে খানিক অপেক্ষা করতে হলো তবে একটা বসার টেবিল পেলো। মঞ্চের মাঝখানে তখন দুজন অভিনেতা - একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা - এর মধ্যেই দর্শকের মন কেড়ে নিয়েছে।
কেবলমাত্র একজনই গাইল, “.... দৌ তিয়াঁঝাং ফিরে গেছে সান্যং শিয়াহ্, দেশে ফেরা যে কী দুঃখের। আমার মনে হয় আমি ঘর ছেড়ে রাজধানীতে গিয়ে ছিলাম নির্বাচনের আবেদন নিয়ে, ঘরে রেখে গিয়ে ছিলাম ছেলেকে, আমার বাবা আর মেয়ের কখনো আর দেখা হলো না ……”
মিন হুয়ে শুনতে শুনতে ধন্দে পড়ে যাচ্ছে। শিন ছিকে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এটা কেমন নাটক? তাহলে কী দৌ এ-র আসল নাম দৌ তিয়াঁঝাং?”
শিন ছির সংক্ষিপ্ত উত্তর, “দৌ তিয়াঁঝাং দৌ এ-র বাবা।”
মিন হুয়ে কেবল শুনলো যে অভিনেতা গেয়ে চলেছে, “...... গোধূলির ডাকঘরে ঢুকে দেখি এক দমকা হাওয়া ঝাপট দিচ্ছে দালানের সামনেটাতে, দৌ তিয়াঁঝাং আমি তো শোবার ঘরে ছিলাম, যখন আমি হঠাৎ ওপরে চেয়ে দেখি এক ভুতনি দাঁড়িয়ে আছে আমার মুখোমুখি। হাতে আত্মরক্ষার তরোয়াল নিয়ে কোথায় গেলো বুনো ভুত? তুমি আমাকে জ্বালালে দেখছি -”
মিন হুয়ে কিছুতেই আর শুনতে পারলো না। প্রথমত, জায়গাটাতে শোরগোল খুব, সব্বাই বকবক করে চলেছে, নাটকের অভিনয়টা যেনো শোরগোলের আবহসঙ্গীত। কাকিমাদের গলার স্বর ট্রাম্পেটের থেকে উপরে, তাতে মঞ্চের উপরে অভিনেতারা কী গাইছে তা শোনা অসম্ভব হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, অভিনয়টা বেশ খারাপ মানের আর চালচলন সব অতিরঞ্জিত। গল্পটা য়ুয়াঁ সাম্রাজ্যের সময়কার যে সেটা বেশ স্পষ্ট। কিন্তু অভিনেতারা পোষাক পরে ছিলো ছিং সাম্রাজ্যের সময়কার। এমন কী তরমুজ টুপিও পরে আছে।
যতো দেখতে থাকলো মিন হুয়ে, ততো তার গুলিয়ে যেতে লাগলো, “অভিনেতারা কী ভুল পোষাক পরেছে?”
শিন ছি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলো, “পরেরটার নাম ‘মেজো বোন ওয়াং পতিবিরহিনী।’ আমার মনে হয় যে জামাকাপড় বদলানোর আর সময় ছিলো না। …… ওপরের দিকে ওটা কে সুঁ হাও?”
হঠাৎ মিন হুয়ের মনে পড়ে গেলো যে সু তিয়াঁ লিখেছে ‘মেজো বোন ওয়াং পতিবিরহিনী’-র কথা তার ডায়েরিতে। যতো বার শিন ছি হাসপাতালে যেতো, ততো বার সুঁ হাও ঠাট্টা করতো সু তিয়াঁর সাথে এই বলে যে সু তিয়াঁ যেনো ‘মেজো বোন ওয়াং’ আর গাইতো ‘মেজো বোন ওয়াং পতিবিরহিনী’ সু তিয়াঁর সামনেই, রাগে সু তিয়াঁ কেঁদে ফেলতো। এই জন্য শিন ছি বহুবার মারপিট করেছে সুঁ হাও-এর সাথে। মিন হুয়ের খুব কৌতুহল হয়ে ছিলো। সেই জন্য মিন হুয়ে মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করছিলো স্তবকটা। গানের কথাগুলো ভীষণ মজার। মিন হুয়ে গানটা ফোনে ডাউনলোড করে নিয়ে ছিলো আর থেকে থেকেই শুনছিলো যখন আর কিচ্ছু করার ছিলো না তখন। আর এখন তো নিজেও গাইতে পারে।
মিন হুয়ে প্রশ্ন করলো, “সেই ছেলেটা যে আমাদের ওপর থেকে থেকে চড়াও হতো?”
শিন ছি সমর্থন করলো, “ঠিক ধরেছিস। তখন ও গাইতে খুব ভালো বাসতো ‘মেজ বোন ওয়াং পতিবিরহিনী’ কী ‘ক্ষীণ কায়া পাণ্ডু বর্ণ আর রুগ্ন, কিন্তু চোখ দুটো যেনো উগরে আছে’ - -”
শিন ছি বলে যেতে লাগলো, “মাথার চুল সব এলোমেলো, ঘাড় খানা যেনো দাঁড়া।”
মিন হুয়ে সঙ্গতে, “আয়নাটা ফেলে দিলো, ফেলে দিলো তার ফ্রেমটাও -”
“একটু নরম হয়ে টান দিয়ে নামালো বড়ো লেপখানা -”
“মেজো ভাই, সে তো আর আমার কথা ভাবে না, তবে আমি কেনো বেঁচে আছি -”
দুজনে গেয়ে চললো আর হেসে চললো। শিন ছি বললো, “তোর সাথে টিহাউসে আসার পর আমি আবার নাটকটার নাম শুনলাম। চল দেখি তোর কেমন মনে আছে। “
মিন হুয়ে মুখের হাসিটার আড়ালে ঢোক গিলছিলো, এই বোধ হয় মুচ্ছো গিয়ে ছিলো আর কী, কপাল জোরে তার মনে আছে গানের কথাগুলো। তারপর শিন ছি ঘড়ি দেখলো। তখনও একঘন্টা সময় ছিলো।
শিন ছি মিন হুয়ের হাতে আলতো চাপড় দিতে দিতে বললো, “ঘাবড়াস না। আমাদের দেরি হবে না। আমি অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছি।”
তারপর জানতে চাইলো, “তং তিয়াঁ হাইয়ের সাথে দেখা করার পরে, যদি ডিএনএ পরীক্ষা থেকে প্রমাণ হয় যে তং তিয়াঁ হাই-এর দত্তক নেওয়া ছেলে আসলে তোর ভাই, তখন তুই কী করবি কিছু ভেবেছিস?”
মিন হুয়ে কোনো মতে বললো, “ওহ্”
তারপর হতবাক হয়ে রইল।
মিন হুয়ে ভাবে নি কিছুই এ ব্যাপারে। শিন ছির সামনে সু তিয়াঁ হয়ে থাকাটাই বেশ কঠিন, তারপর আবার ভাইয়ের সামনে তার নিজের দিদি হয়ে থাকা …… সে তো আরো চাপের। যতো ভাবতে লাগলো ব্যাপারখানা, ততো উদ্বিগ্ন হতে লাগলো। সু তিয়াঁর মৃত্যুর কথাটা শিন ছিকে বলে নি শুধু শিন ছির অসুস্থতার জন্য। কিন্তু সু তিয়াঁর কথাটা তার ভাইয়ের থেকে লুকিয়ে রাখার তো কোনো দরকার নেই। যাই হোক, শিন ছির সামনে সত্যিটা কিছুতেই বলতে পারবে না ও।
মিন হুয়ের আবার বুক ধড়ফড় করতে লাগলো। দুই সহোদরের দেখা হবার পরে, অগ্রজা অর্থাৎ জিয়েজিয়ে আর অনুজ অর্থাৎ দিদি -র মধ্যে চেনাশোনা হবার পরে, জিয়েজিয়ে কী গোপণে দিদিকে বলবে আগে যে জিয়েজিয়ে আসলে সহোদরা নয়। তারপর দিদির সথে জিয়েজিয়ে একটা বোঝাপড়া করে নেবে সত্যিটা শিন ছির থেকে আড়াল করার জন্য? নাকি পিঠে একটা বোঝার মতো বয়ে বেড়াবে শেষ পর্যন্ত, কাউকে কিচ্ছু বলবে না?
এক কথায় মিন হুয়ে মনে মনে প্রস্তুত নয় সু তিয়াঁর ভাই-এর সাথে দেখা হবার জন্য, কোনো পরিকল্পনা করা তো অনেক দূরের কথা। কিন্তু এটাও ঠিক কথা সে যদি ভাইকে নিয়ে কী করবে সেটা ভেবে না থাকে, তবে সে খুব দায়িত্বশীল জিয়েজিয়ে নয়।
মিন হুয়ে উত্তর দিলো, “সেটা নির্ভর করছে আমার ভাই কী ভাবছে, বা কী করতে চায়, তার ওপরে। আমি আমার দিক থেকে ওকে যতোটা সম্ভব সাহায্য করবো।”
উপায়ান্তর না দেখে মিন হুয়ে বলে চললো, “সে যদি এখানকার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে থাকে আর কোথাও না যেতে চায়, তাহলে আমি এদিকে কোথাও এসে কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবো। দেখাশোনা করার জন্য কেউ থাকলে ভালোই হয়।”
শিন ছি বললো, “হুম্।”
তারপর পকেট থেকে মোবাইল বার করে কী যেনো খুঁজতে লাগলো।
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “কী করছিস তুই?”
শিন ছি জানালো, “এখানে বাড়ির দাম কতো তাই দেখছি।”
মিন হুয়ে তর্ক করলো, “আমি মোটেও বলি নি এখানে থাকতে গেলে বাড়ি কিনে থাকতে হবে। ভাড়া নিলেও চলে।”
শিন ছি যুক্তি দিলো, “এটা বেজিং বা সাংহাই নয়। এখানে বাড়ির দাম খুব বেশি নয়। কেনাই যায়।”
তারপর ইন্টারফেসটায় আঙুল দিয়ে ক্লিক করে দেখালো, “দেখ, এখানে একটা তরমুজের বাগান আছে। তিরিশ একর জমি, সঙ্গে দোতলা বাড়ি। দামটা দর করা যাবে। চলবে এটা?”
মিন হুয়ে যেনো আকাশ থেকে পড়লো, “তরমুজের বাগান? মানে?”
মিন হুয়ে একটা কথার কথা বলেছে, শিন ছি সে কথাতেও গুরত্ব দিয়েছে। শিন ছি আবার বললো, “পয়সা রোজগার করতে হবে তো? এখানে সেটা করবো কী করে?”
শিন ছি ওপরের ছবিটায় হাত দিয়ে বললো, "কেনো তরমুজ, ফুটি, খরমুজা, সর্দা ফলাব। আমরা সবাই ফুটি ভালো বাসতাম, বিশেষ করে তুই। তুই সারাক্ষণ রাধুনিকে তোয়াজে রেখে আমাদের জন্য ফুটি কাটতিস। আমরা একটা ফলের বাগান আর ব্যবসা করতে পারি দুজনে।”
মিন হুয়ে চোখ তুলে শিন ছির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো, “সত্যি?”
যেমন করেই শুনে থাকুক না মিন হুয়ে, ওর কেবল মনে হচ্ছিলো ব্যাপারটা বোকামো।
কিন্তু শিন ছি নিশ্চিত করলো, “সত্যি।”
মিন হুয়ের অবিশ্বাস্য লাগছিলো, “তুই নিউইয়র্ক থেকে এখানে আসবি? ফুটি চাষ করার জন্য? তুই কার সাথে ঠাট্টা করছিস?”
শিন ছির স্বরে ঠাট্টা নেই, “তুই মত দিস নি যে আমরা একসাথে থাকবো আর তুই যেখানে যাবি আমিও সেখানে যাবো তোর সাথে? তুই যদি এখানেই থিতু হবি বলে ঠিক করিস, তাহলে …… আমি খুব বেশি হলে ফুটি চাষ করতে পারি। অন্য কোনো ফলে আমার কোনো উৎসাহ নেই।”
মিন হুয়ে প্রশ্ন করলো, “আমার কেনো মনে হচ্ছে যে এই ব্যাপারটায় ভরসা করা যায় না?”
শিন ছি অন্য উপায় দিলো, “তাহলে আমাদের ভাইকে রাজি করাতে হবে আমাদের সাথে একসাথে নিউ ইয়র্কে যাবার জন্য।”
‘আমাদের ভাই!’ - বাজলো মিন হুয়ের কানে।
মিন হুয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে খুব জোর দিয়ে বললো, “যেতে পারবো না।”
শিন ছি কারণ জানতে উৎসুক, "কেনো?”
মিন হুয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করলো, “এ বছরে আমার ভাই তেইশ বছর পেরোবে। ও যদি এখনো মিংশুই শিয়াহ্ -তেই থাকে, তবে ও ইংরেজি বুঝবে এমন সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ।”
শিন ছি জানতে চাইলো, “আর তুই? তুই কতোটা বুঝতে পারবি?”
মিন হুয়ের দুচোখে আগুন ঝলসে উঠলো। শিন ছি মাথা চাপড়ে বললো, “মাপ কর। আমি ভুলে গিয়ে ছিলাম। আমি কথা দিয়েছি যে এসব কথা জানতে চাইবো না।”
মিন হুয়ে বললো, “সময় হয়ে গেছে প্রায়। চল, বেরিয়ে পড়ি।”
শিন ছি উত্তর দিলো, “আমি ড্রাইভারকে ডেকেছি।”
ঠিক নটা দশে মিন হুয়ে আর শিন ছি পৌঁছলো একশো সাত নম্বর এক্সএক্স রোডে, যেখানে একটা পোড়ো বাসাবাড়িতে তং তিয়াঁ হাই থাকে বলে জানিয়েছে। তং তিয়াঁ হাই প্রৌঢ়, বয়স প্রায় ষাটের কোঠায়, গোল মুখ, বেঁটে, মোটা। চলার সময় মেঝের থেকে পা ওপরে তুলতে পছন্দ করে না, পা ঘষে ঘষে চলে, পায়ের চপ্পল ঘরের মেঝেতে প্রচুর আওয়াজ তোলে। তার চোখ দুটো হিংস্র, মধ্যিখানে লাল থেকে বেগুনী হয়ে যাওয়া একটা রোজেসি নাক। গলার স্বর মোটা আর পর্দা ওপরের দিকে যেনো গলায় শ্লেষ্মা জমেছে।
তং তিয়াঁ হাইয়ের দত্তক নেওয়া ছেলের নাম তং মিংহাও। পরিবারের লোক খুঁজে বারকরার যে ওয়েবসাইট তার ভলান্টিয়ারদের মতে দত্তকপুত্রের ব্যাপারে তং তিয়াঁ হাই-এর একটা খুব সজাগ যত্ন আছে এবং ছেলের ব্যাপারে সমস্ত যোগাযোগ সে নিজেই করে। কয়েকটা খুব সাধারণ বিষয় ছাড়া তং মিংহাও-এর এখনকার হালচাল বিশেষ কিছুই জানা যায় না ওয়েবসাইট থেকে। জানা যায় না যে সে কদ্দুর লেখাপড়া করেছে, সে কী কাজ করে আর কোথায় কাজ করে।
তং তিয়াঁ হাই একটা একানে ঘরে থাকে, পনেরো বর্গমিটারের থেকেও ছোটো ঘরটা। ঘরটা খুব অগোছালো। উনুনে পুরোনো তেলচিটে জমে আছে। তবে মেঝেটা পরিষ্কার। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে মেঝেটা যত্ন মোছা হয়েছে সবেমাত্র। ঘরে তখনও জলের দাগ লেগে আছে।
মিন হুয়ে ঘরের সমস্তটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। ঘরে কেবল তং তিয়াঁ হাই আছে, তং মিংহাও-এর কোনো চিহ্ন নেই।
তং তিয়াঁ হাই-এর দেওয়া কোক নিয়ে তাতে একটা চুমুক দিয়ে শিন ছি জানতে চাইলো, “শুশু তং, আপনি কী বাড়িতে একা?”
তং তিয়াঁ হাই এককথায় জানালো, “হ্যাঁ।”
শিন ছি আবার প্রশ্ন করলো, “আপনার ছেলে কোথায়?”
তং তিয়াঁ হাই উত্তর দিলো, “বেশ কয়েক বছর সে আমার সাথে থাকে না।”
শিন ছি আরো জানতে চাইলো, “আপনি কী বিবাহিত?”
তং তিয়াঁ হাই আবার এককথায় জানালো, “না।”
শিন ছি সোজাসুজি প্রশ্ন রাখলো, “শহরের বাইরে কাজ করে নাকি?”
তং তিয়াঁ হাই আবারও এককথায় সারল, “না।”
মিন হুয়ে আর শিন ছি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। দুজনেই অবাক।
তং তিয়াঁ হাই অনেকক্ষণ নিলো দ্বিধা কাটাতে। তারপরে জানালো, “সে অসুস্থ। তার মাথার ব্যামো আছে।”
দুজনেই চমকে উঠলো কোনো মতে একটা ‘ওহ্’ বললো একসাথে, “মাথার ব্যামো”-টা একটা উপমা না সত্যিকারের স্নায়ু ও মগজের অসুখ, সেটা না জেনেই বললো।
তারপরেই তং তিয়াঁ হাই চুপ করে গেলো। চোখ দিয়ে মাপতে লাগলো সামনের দুই চরিত্রকে। বারবার। পড়ে নিতে লাগলো তাদের প্রতিক্রিয়া।
মিন হুই জানতে চাইলো, “মগজের অসুখটা কী ধরেনের?”
আবার খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। খানিক আমতা আমতা করে তং তিয়াঁ হাই জানালো, “সাইকোপ্যাথি, প্যারানয়া। অস্থির থাকে সারাক্ষণ।”
শিন ছি আনমনে মিন হুয়ের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কতোটা মারাত্মক পরিস্থিতি?”
তং তিয়াঁ হাই অকপট, “মারাত্মক। বহু বছর ধরে সে হাসপাতালে আছে।”
তং তিয়াঁ হাই-এর আঙুল কাঁপতে লাগলো। একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে চললো, “ওর সারাক্ষণ মনে হতো যে কেউ ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করছে, ওকে মারবে। ওর হাত-পা ভেঙে দেবে - এরকম আর কী। আমি ওকে ঘরে বন্ধ করে রাখতাম। পরে …… একদিন পুরো বাড়িটা জ্বালিয়ে প্রায় ছাই করে ফেলে ছিলো। পড়শিরা সব ভয় পাচ্ছিলো। তাই ওকে হাসপাতালে দিয়ে আসতে বাধ্য হই।”
শিন ছি একটু দ্বিধার সঙ্গেই প্রশ্ন করলো, “আপনার কি মনে হয়ে যে এই অসুখ …… তার ছোটো বয়সে ছেলেধরাতে ধরার জন্য হয়েছে?”
তং তিয়াঁ হাই-এর সাবলীল উত্তর, “আমার মামাতোভাই কাউকে বলে ছিলো আমার জন্য ওকে এনে দিতে। সে বলে ছিলো যে বাচ্চাটার পরিবার ভারি গরীব। বাচ্চাটার দেখাশোনা করতে পারে না। তখন দুটো ছেলে ছিলো। দুটো ছেলেরই বয়স একবছরের কিছু ওপরে। একটা ছিলো রোগা, ছোট্টোখাট্টো। আরেকটা ফর্সা আর মোটাসোটা। আমি ফর্সা আর মোটাসোটা বাচ্চাটাকে নি। আমি লোকটাকে কুড়ি হাজার য়ুঁয়াঁ দিয়ে ছিলাম, এ মনে করে যে পরে তো সে মারাই যাবে, যেটা ভালোই …”
মিন হুয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তাহলে, সে কি জানে যে সে আপনার আপন নয়?”
তং তিয়াঁ হাই মাথে নেড়ে বললো, “আমি কোনো দিন তাকে বলি নি। সে এখনো পর্যন্ত জানে না।”
মিন হুয়ে একটু ধন্দে পড়লো, “আপনিই তো পরিবার খোঁজার ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে ছিলেন, তাই না?”
তং তিয়াঁ হাই সোজাসুজি জানালো, “আমি গত মাসে হাসপাতালে গিয়ে ছিলাম, ডাক্তারের সাথে দেখা করার জন্য। ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম যে আমার ক্যান্সার হয়েছে। ডাক্তার বলেছে মেরে কেটে আর মাস ছয়েক আছি আমি। অনেক দ্বিধাদ্বন্দ কাটিয়ে আমি ঠিক করে ছিলাম যে ছেলেটাকে ওর আপন বাবা-মা খুঁজে বার করতে সাহায্য করবো। আমি যাবার পরেও ওকে দেখাশোনার করার জন্য তো কাউকে লাগবে। ওয়েবসাইটের লোকেরা বলেছে যে তুমি নাকি খুব সম্ভবত ওর আপন জিয়েজিয়ে।”
মিন হুয়ে একটু দ্বিধায় পড়লো। সেটা কাটিয়ে ঘাড় নেড়ে সায় দিলো।
তং তিয়াঁ হাই খুশি হয়ে মিন হুয়ের হাত ধরে নাড়া দিলো। বললো, “খুব ভালো।”
ড্রয়ার থেকে একটা ফোল্ডার বার করে মিন হুয়ের হাতে দিয়ে বলতে লাগলো, “চিকিৎসার কাগজপত্র যা আছে তার সবটা এখানে রেখেছি। কী রোগ, কতো দিন ধরে …… দুঃখিত। আমি হাওকে এসব বোঝানোর সাহস করি নি। আমি ভয় পেয়েছি যে লোকের কানে গেলে মারাত্মক ঝামেলা হতে পারে। মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্স ছাড়া, মাসে মাসে হাসপাতালের খরচ, খুব কম তো নয়। তাই আমি নিজেও স্বীকার করতে রাজি ছিলাম না। আমি এখনো স্বীকার করতে রাজি নই।”
মিন হুয়ে তাড়াহুড়ো করে প্রশ্ন করলো, “এটা ঘটলো কী করে?”
তং তিয়াঁ হাই বলতে লাগলো, “যখন স্বাভাবিক থাকে, তখন ও বেশ স্বাভাবিক। ছোটো বেলায় মিষ্টি ছিলো খুব। একটু ভীতুও ছিলো। টয়লেট ফ্লাশ করার শব্দেও ভয় পেতো। এটা ছেলেদের মধ্যে খুব স্বাভাবিক নয়। এই কারণে ওকে খুব মার খেতে হয়েছে। আমারই দোষ। আমিও মদে চুর হয়ে থাকতাম। পান থেকে চুন খসলেই আমিও ছেলেটাকে মারধর করতাম। আমিও খেপ খাটি, পুরো সময়ের বাধা কাজ তো নয়। আমি ওকে ইস্কুলে পাঠাতে পারি নি।”
হয়তো বিবেক জেগে উঠেছে তাই তং তিয়াঁ হাই অনুতাপ করতে শুরু করেছে। অনেক ক্ষণ আপন মনে বিড়বিড় করে বকে গেলো, অনেকক্ষণ কথা বলার পরেও। মিন হুয়ে বা শিন ছি তাকে থামানোর চেষ্টা করলো না। তাছাড়া ওরাও পরিস্থিতিটা আরো বুঝে নিতে চাই ছিলো। তাই ওরাও চুপ করে শোনাটাকে গুরুত্ব দিয়ে ছিলো।
মিনিট দশেক বিড়বিড় করার পরে তং তিয়াঁ হাই বললো, “তোমরা ওকে দেখতে চাও? নিশ্চয়ই দেখবে। তবে আমি এটাও বুঝি যে তোমরা ওকে দেখতে নাও চাইতে পারো। যা হোক ওর অবস্থাটা এখন আর পাঁচজনের মতো তো নয়। আর তোমাদের জন্যও ব্যাপারটা গুরুতর - খানিকটা বোঝা তো বটেই।”
মিন হুয়ে জানতে চাইলো, “আপনার কাছে হাসপাতালের ঠিকানা আছে? আমি ওকে দেখতে চাই যতো শিগগির সম্ভব।”
তং তিয়াঁ হাই ফোল্ডারটার দিকে দেখালো, “ওতেই ঠিকানা আছে। হাসপাতালটার নাম ‘সিনিং হাসপাতাল।’ গাড়িতে গেলে এখান থেকে একঘন্টা লাগে। হাসপাতালে একটা অতিথিশালা আছে। তোমরা সেখানে থাকতে পারবে।”
মিন হুয়ে কৃতজ্ঞতা জানালো, “ধন্যবাদ।”
তারপর উঠে পড়লো। শিন ছি জিজ্ঞেস করলো, “শুশু আপনার কাছে আপনার ছেলে মিংহাও-এর কোনো ছবি আছে কি?”
তং তিয়াঁ হাই জানালো, “হ্যাঁ, হ্যাঁ। খুব আছে।”
তারপর উঠে একটা কার্ডবোর্ডের বাক্স বার করে তার থেকে চারটে ছবি বার করে মিন হুয়েকে দিয়ে বললো, “এই ছবিটা দু বছর বয়সের। এটা পাঁচ বছরের। এটা তেরো বছর বয়সের। আর এটা গত বছরের, যখন বয়স বাইশ হলো।”
শিন ছি নিজের মোবাইল ফোনে একেক করে ছবি তুলে নিলো।
তেরো বছরের ছবিটার দিকে মিন হুয়ে অপলক চেয়ে আছে দেখে তং তিয়াঁ হাই বললো, “তোমাদের ভাইবোনেদের মধ্যে বেশ মিল আছে চেহারার। আমি প্রথম দেখাতেই বুঝে গেছি যে তুমি তার আপন জিয়েজিয়ে।”
একটা ফর্সা ছেলে। লম্বা, সোজা মেরুদন্ড। একাকীত্ব ভরা দুচোখ নিয়ে চেয়ে আছে। মুখে লাজুক হাসি।
গায়ের লোম না থাকলে, মিন হুয়ে একটা মেয়ে বলে ভুল করতো।
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-09.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/08/jpda-chapter-11.html
No comments:
Post a Comment