সংকটোন্মচন
“এমসিপি!” মনের ভেতর এই শব্দটাই বাজল লেখিকার। মুখে বললেন, “আজ তাহলে আসি।” উল্টোদিকের বেঞ্চে মুখোমুখি বসা
সম্পাদক বললেন, “বেশ, তাহলে মনে রাখবেন যে লেখাটাতে আরও যৌনতা আনতে হবে।” লেখিকা উঠে পড়েছিলেন বেঞ্চ থেকে।
এবার লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেলেন রাস্তা ধরে। ভাবছিলেন, “লোকটা জানে না যে এইভাবে ‘গল্পে আরও যৌনতা আনুন’ বললে যৌন হেনস্থা করা হয়? আপিসে
কাজ করে, আর জানে না? ব্যাটা, ঠিক জানে। কোনটা বলবে, কখন বলবে, কখন কোন দলের হয়ে
বলবে, পীড়িতের হয়ে বলবে নাকি পীড়ককে পীড়িত বানাবে সব ছকা আছে শয়তানটার। সেই জন্যই
তো আপিসের ভেতর ধানাই-পানাই করে বাইরে বেরিয়ে এসে চায়ের দোকানে বলল যাতে কোনো কেস
না ঠোকা যায়। যাতে হজম করে নিতে হয় পথচলতি আর পাঁচটা যৌন আক্রমণের মতো। ...... আবার
এ লোকটার এসব কেচ্ছা লোককে জানাতে গেলেও এ ব্যাটাকেই চাই। কী জ্বালাতন! যাবতীয়
বিরক্তি, গা রি-রি আর গা গুলোনো চেপে যেতে হবে । .... মেল সভিনিস্টিক পিগ।”
মন ঠান্ডা হতে তিনি ঠাহর করলেন যে আপিসপাড়ার
ফেরিঘাট ছাড়িয়ে উত্তরে চলে এসেছেন বেশ খানিকটা। তাই আর দ্বিধা না করে আরো
উত্তর-পুবে চললেন। বইপাড়ায় এগলি ওগলি তস্য গলি খুঁজে বার করলেন বাংলা হরফে ছাপা
বাৎসায়ানের কামসূত্র। বইটাতে কোনো ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু সংস্কৃত শ্লোকের অন্বয়
বিশ্লেষণ করে দেওয়া আছে। লেখিকা যারপরনাই খুশি হলেন। অন্যের চেবানো তত্ত্ব বা তথ্য
গিলতে হবে না দেখে। ফলে প্রায় হাওয়ায় উড়তে উড়তে পৌঁছে গেলেন কাছাকাছি ফেরিঘাটে।
কিন্তু হাওড়া যাওয়ার লঞ্চটা লেখিকার সামনের
দিয়ে চলে গেল। পরের লঞ্চের অপেক্ষায় তিনি জেটিতে বসে পড়লেন। হ্যালোজেন আলোয় বইটা
পড়তে শুরু করলেন। মাঝে মাঝে একটা-আধটা সন্দেহ কাঁটা দিচ্ছিল যে সব শ্লোকের মানে
ঠিকঠাক বুঝছেন কিনা। ভরসা করা যায় এমন নৈর্ব্যক্তিক পণ্ডিত ব্যাক্তিত্বের
উপস্থিতির অভাব টের পাচ্ছিলেন তীব্রভাবে। তবুও কয়েক ভাঁড় চা, কয়েক ঠোঙা ঘটি-গরম, খেয়ে ফেললেন। তাঁর চারপাশে প্রচুর ভিড়
জমল, আবার খালিও হয়ে গেল। ঝোলার মধ্যেকার ফোনটা কাঁপতে তাঁর হুঁশ হলো। ফোনটা বার
করে দেখলেন কাকিমার ফোন। সময় দেখে টের পেলেন যে বাড়ি ফেরার সময় পেরিয়ে গেছে ঘন্টা
দুয়েক আগেই।
লেখিকার মা-বাবা ও কাকা গত হওয়ার পর থেকে কাকিমা তাঁর সঙ্গেই থাকেন। লেখিকার সহোদর ও তাঁর পরিবার চেয়েছিলেন যে লেখিকা ও
কাকিমা তাঁদের সাথেই থাকুন। কিন্তু লেখিকার মনে হয়েছিল যে ওঁদের সাথে থাকলে তাঁর
নিভৃতি ভাঙবে, ফলে তিনি অস্থির হয়ে পড়বেন ওঁদের থেকে নিজেকে আড়াল করার জন্য এবং সুসম্পর্ক
নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি একলাই ছিলেন পিতামহের ভিটেতে তাঁর পৈতৃক অংশে। কাকা গত হতে নিঃসন্তান
কাকিমা তাঁর সাথে থাকতে চেয়েছিলেন যখন, তখন তিনি বাধা দেননি। শর্ত দিয়েছিলেন যে কাকিমাকেও
রাঁধুনির হাতে খেতে হবে।
কাকিমার সাথে কথা বলে লেখিকা ফোন আর বই দুইই
ঝোলাস্থ করলেন। তারপর আরেক ভাঁড় চা খেতে খেতে উতলা হয়ে পড়লেন হাওড়াগামী পরের
লঞ্চের জন্য। জেটিটা প্রায় ফাঁকা। যে কটা লোক রয়েছে তাদের আবার লেখিকাকে দেখে
ধর্ষণ পেলেই হয়েছে। গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়া যায়। কিন্তু গঙ্গার ঢেউ ভাঙা জলে চোখ রেখে
বুঝলেন যে ওই জলে ঝাঁপাতে হলে ঘেন্না কাটিয়ে উঠতে হবে। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই
কাঙ্খিত লঞ্চ এসে গেল। ঘন্টাটাক পরে নিজের বাড়িতে পৌঁছে স্নান খাওয়া সেরে লেখিকা
পরম উৎসাহে বাৎসায়নের কামসূত্র পড়তে লাগলেন।
বইটা রাতারাতি শেষ করে তিনি বুঝতে পারলেন না যে
কেন অন্তত চারদিন অন্তর পুরুষ মানুষের দাড়ি কামানো উচিৎ, কেনই বা দাড়ি কামাবার কথা
থাকলেও দাঁত মাজার কথা কিছুই বলা হয় নি যেখানে কাম চরিতার্থ করার জন্য মুখগহ্বরের
বিষদ ব্যবহারের আলোচনা আছে। এইসব দ্বন্দ ফিরে ফিরে এলো সারাদিন কলম ঠেলা, ফাইল
ঘাঁটার ফাঁকে। নানান বিরোধ, ঝগড়া নিষ্পত্তির ফাঁকে ভেবে চললেন কী করে একটা ফিল্ডট্যুর করা
যায় যাতে হাতেগরম অভিজ্ঞতা লেখার ছত্রে ছত্রে থইথই করতে থাকে। মাঝে মাঝে টেলিফোনে
নম্বর দেখতে লাগলেন যদি তাঁর এই প্রেমিক, সেই প্রেমিক, ঐ প্রেমিকদের কারুর সাথে
পরামর্শ করা যায়। ফোন করতে পারলেন না কিছুতেই। এঁদের প্রবল ভয় যে লেখিকা বেফাঁস লিখতে
পারেন তাঁদের প্রত্যেকের এক্সট্রাম্যারিটাল কেচ্ছা কারণ লেখিকার নাকি কোনো
ইনহিবিসন নেই। তিনি বিয়ের গোলামী করেন না। আর তাই নাকি তিনি অকাতরে নিজের এবং
বিবাহিত প্রেমিকদের প্রেমচর্চার তোড়ে ভেঙে দিতে পারেন প্রেমিকদের নিজের নিজের
সুখনীড়। ফলে লেখিকা ভয় পাচ্ছেন
যে যৌনতা নিয়ে এঁদের সাথে আলোচনা করে কিছু লিখলে, তা প্রকাশ পেলে এসব প্রেম তাঁর কেটেও
যেতে পারে; তেমন হলে প্রান্তযৌবনে তিনি নতুন করে প্রেমিকই বা পাবেন কোথায়, বিশেষত
যাদের কাঁধে মাথা দু দমক দীর্ঘশ্বাস ফেলা যায়, কিন্তু তাদের জন্য ঘুম থেকে উঠেই
ভাত রাঁধতে হয় না। তবে সমস্ত আবেগের অত্যাচার টপকে, দিনশেষে মাথায় তেইশ ওয়াট সিফিএল জ্বালিয়ে
একখানা দারুণ ফিল্ডওয়ার্কের প্ল্যানও বানিয়ে ফেললেন।
ফিল্ডট্যুরস্
শনিবার অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে পড়লেন। যদিও
কাকিমা জানলেন যে তিনি আপিসের কাজে মফস্বলে যাচ্ছেন আসলে তিনি পৌঁছলেন মন্দারমণি।
বিচের ওপর একটা হোটেলের উঠলেন যেখানে সব কটা ঘর আর তার লাগোয়া বারান্দা মিলিয়ে
আলাদা আলাদা কটেজ। স্নান-খাওয়া মিটিয়ে টেনে ঘুম লাগালেন সন্ধে অব্দি। সন্ধে নাগাদ
জমিয়ে চা-পকৌড়া খেলেন হোটেলের লাগোয়া খড় ছাওয়া বিনা দেওয়ালের রেস্তোরাঁতে। মিস
মার্পলের মতো উল বুনতে বুনতে ঘন্টা তিনেকের পর্যবেক্ষণে জেনে গেলেন যে কোন কোন ঘরে
জোড়া জোড়া লোকজন আছে; আর সেই সব ঘরের কোনগুলোর বারান্দায় একেবারেই আলো পৌঁছয় না।
রাত নিশুতি হতে কান পাতলেন একশ বিরাশি
নম্বরে। সেখানে শুধুই নিশ্বাসের শব্দ। একশ পঁচাশিতে টিভি চলছে। দুজনেই হেসে খুন।
লেখিকা ভাবলেন যে ফিরে আসা যাবে পরে। একশ নব্বইতে একজন আরেকজনের চুল বেঁধে
দিচ্ছিল। এই ঘরের লাগোয়া বারান্দায় লেখিকা জাঁকিয়ে বসলেন। ঘরের আলো নিভে যেতে
লেখিকা চোখ বন্ধ করলেন যাতে কান বেশি সজাগ হয়। দুজনের কথার আওয়াজ মিলিয়ে গিয়ে
নিশ্বাসের ওঠাপড়ার এলোমেলো ছন্দ যখন কিছুক্ষণ স্থায়ী তখন চোখ মেলে লেখিকা দেখলেন
যে খাটের ওপর পদ্মাসনে বা বাবু হয়ে দুজনেই বসে জোড় হাতে প্রার্থনার ভঙ্গীতে।
খানিকক্ষণ সেই জোড়া প্রার্থীর দিকে তাকিয়ে লেখিকা টের পেলেন যে তাঁর পিঠ বেয়ে কিছু
একটা উঠছে মাথার দিকে। অতএব পর্যবেক্ষণে ইতি টেনে নিঃশব্দে ঝটকা দিয়ে গায়ের কালো চাদর খুলে ফেললেন। তারপর হালকা
পায়ে ছুটে নিজের ঘরের সামনে পৌঁছে বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে চাদরটাকে উথাল পাথাল
ঝাড়তে গিয়ে বুঝলেন যে জন্তুটা কামড়ে ধরে আছে চাদরটা। তাই সেটা ভারি লাগছে। অতএব
চাদরটাকে জন্তুটার চারপাশে পুঁটলি পাকিয়ে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারলেন। মাটির চায়ের ভাঁড়
রেল লাইনে ছুঁড়ে মারলে যেমন আওয়াজ হয়, তেমন একটা আওয়াজ হলো। ফের চাদরটা কুড়িয়ে ঝাড়তে
গিয়ে দেখলেন যে জন্তুটা তখনও তাতে আটকে আছে। ঘরের মধ্যে থেকে টর্চ এনে দেখলেন যে
চাদরে একটা হারমিট ক্র্যাব সেঁটে বসে আছে। অতএব অভিযানে ইতি টেনে তিনি নিজের ঘরে
ঢুকে গেলেন। কোনো রকমে অশান্ত মনে রাতটুকু কাটিয়ে বিফল ফিল্ডট্যুরের হতাশা নিয়ে বাড়ি
ফিরলেন পরদিনই।
একটা অধৈর্য সপ্তাহ কাটিয়ে পৌঁছলেন এক
বেশ্যাবাড়িতে। ততদিনে তাঁর মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে যে যৌনতা বেচাকেনার বাজারে
অন্তত যৌনতার ঘাটতি থাকবে না, হয়ত উচিৎ মূল্য দিলে এসথেটিক থেকে প্রস্থেটিক সব
কিছুই মিলতে পারে। সেখানে মালকিন বললেন, “তা এই দিনের বেলাতেই লাগবে? কেমন মেয়ে লাগবে তোমার?” লেখিকার যে মেয়ে লাগবে না সে কথা মালকিনকে
বোঝাতে গিয়ে শুনলেন যে দেশি-বিদেশি মেয়েছেলে খদ্দেরও আছে নাকি এ পাড়ার ছেলেমেয়েদের!
ফলে লেখিকার খুশি বেড়ে উঠল শতগুণ। তাঁর অবশ্য রাত্রিবাসের খরচ বেশিই পড়বে দেখা
গেল। কারণ অন্য ক্লায়েন্টের সঙ্গে বেইমানী করে তাঁকে এমন ঘর দেওয়া হবে যাতে
দুপাশের ঘরের সারা রাতের ঘটনা তাঁর চক্ষুষ্কর্ণগোচর হয়।
প্রথম রাতে একটা ঘরে প্রথমে
এলো একটা পাঁড় মাতাল। সে লোকটা মেয়েটার গলাটা জড়িয়ে ধরে খাটে ঝাঁপাল বটে দমাস শব্দ
করে, তারপর জামাকাপড় খোলা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটার কাঁধে এমন লালা মাখালো যে মেয়েটা
লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। তাতে বোঝা গেল লোকটা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে গেছে। তখন মেয়েটা লোকটার
পকেট হাতড়ে টাকা-পয়সা বার করে ফটাফট গুণে দেখে, কিছু পয়সা লোকটার পকেটে ফিরিয়ে
দিল। তারপর ঘরের দরজা খুলে দুটো মিচকে মতো ছোকরাকে নিয়ে এসে লোকটাকে হ্যাঙারে
টাঙানোর মতো করে ছেলেদুটোর কাঁধে ঝুলিয়ে বার করে দিল। ফের ঘরটা ফিটফাট করে, চুল
আঁচড়ে, আরেক প্রস্থ লিপস্টিক বুলিয়ে ঘরের আলো-পাখা বন্ধ করে দিয়ে ঘরটা থেকে চলে
গেল।
অন্যঘরে তখন তিনটে মেয়ে দারুণ ঘুরে ঘিরে
নাচছে। সঙ্গতে মোবাইলের ফিনফিনে “ডার্লিং তেরে লিয়ে”। তুমুল সিটি আর হাততালির মধ্যে মালকিন ধেয়ে এলো, “খান্কির ছেলে, টিভি দেখ বাড়ি
গিয়ে।” ছেলেগুলোর একটা বলল, “তিনজনের প্রত্যেকের একঘন্টার পয়সা দিয়েছি। সবে চল্লিশ মিনিট হয়েছে।” আরেক জন বলল, “তোমার মেয়েরা তো জামা কাপড় খুলল
না!” আরেক জন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, সকলের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলা মেরে ঘর থেকে সকলকে
বার করে দিতে দিতে মালকিন বলতে লাগল, “এই ছুঁড়ি ফাঁকা ঘরে গিয়ে ওদের কুড়ি মিনিট সেরে দি দিকি, আর সব খুলে নাচবি...” একটু পরে মালকিন লেখিকার ঘরে এসে
বলল, “আজ বাজার গরমও আছে, আর তোমাকে অনেক রকম দেখাতেও হবে, তাই ওদের মাঝপথে বার করে
দিলুম আরকি। এসব আবার তুমি কিছু লিখ নি বাপু, তাহলে আমার বিসনেসে রিসেশন লেগে
যাবে।” লেখিকা তখন অন্য সিনে মগ্ন। একটা বেশ প্যাংলা মতো লোক মেয়েটাকে বিছানায় আছড়ে
ফেলে বেশ দ্রুতবেগে সংগম সারছে। আর মেয়েটা আকুলি-বিকুলি করে বলে চলেছে, “দুশো টাকা আরও লাগবে কিন্তু, আপনে
মোজাটা পরেন নি, পরে ঝামেলা করবেন না।”
লেখিকা কিন্তু দুশো টাকার রফা দেখার অবকাশ
পেলেন না। তার আগেই প্রথম ঘরে নাটক জমে উঠেছে। মালকিন একটা কাঠের খিল দিয়ে প্রায়
মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছিল বিছানায় আধশোয়া মাস্তান গোছের লোকটার, “হারামি, তোর বাপের হেরেম পেয়েচিস?
আগের দিনের টাকা দিস নি, আবার এসেছিস? তোর পার্টিকে চাঁদা দুব, তুইও ফিরিতে মজা
নিবি দুটো তো হবে নি। হয় দুদিনের মাল ছাড় নাহলে বিদেয় হ” মাস্তানও গোঁফ মুচড়ে হুঙ্কার দিল,
“বজ্জাত মেয়েছেলে তোমার ব্যবসা
উঠিয়ে দেব জানো? কর্পোরেশনের রোলার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেব- আহ্” মাস্তানের হুঙ্কার থমকে গেল।
মালকিন এক ঘা কষিয়েছে তার হাতে। “বেরো শিগ্গির, নাহলে মেরে তোর খুলি ফাঁক করে খালের জলে ভাসিয়ে দেব। তোর
কপ্পোরেসনের মুখে মুতি, মিউনিস্যাল্টির ইয়ে করি...” মাস্তান হাত বাড়িয়ে খিলটা কাড়তে
গেল যেই অমনি ওর মাথায় মেয়েটা একটা সাঁড়াশি দিয়ে এক ঘা কষিয়ে দিল। অবাক চোখে
মাস্তান মেয়েটার দিকে তাকাতে গিয়ে দেখল মালকিনের মাস্তানরা সব্বাই ঘরের দরজায়। সে
তখন মাথার আলুতে হাত বুলোতে বুলোতে বেরিয়ে গেল।
অন্যঘরটা তখন অন্ধকার। আলো জ্বলতে দেখা গেল
একটা মেয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করছে। আর তার খদ্দের বলছে, “তুমি ভাই ওই চেয়ারটাতে বোসো। আমি
খানিক তোমাকে দেখি।” মেয়েটা বলল, “জামা পরে না খুলে?” লোকটা বলল, “খানিক খুলেই নাহয় বোসো। দরজায় টোকা
পড়লে আমাকে জাগিয়ে দিয়ে, একটু সামলে দরজা খুলো, আমরা যেন ...ইয়ে.. মানে করছিলুম।” মেয়েটা জামাকাপড় খুলতে খুলতে লোকটার নাক ডাকতে লাগল।
অন্যঘরে তখন তখন প্রচলিত নয়-ছয়কে অর্ধেক করে,
অনুভূমিক তলের সমান্তরাল মোচড় দিয়ে একটা অভিনব মুদ্রার জন্ম হয়েছে এবং ঝট করে সেই
মুদ্রা ভেঙে নারীপুরুষ যথাকার ধারণ করতেই মেয়েটা বলল, “ওয়াক্। একশ টাকা বেশি দিন। এরকম
উল্টোপাল্টা কাজ আমি করি না।” লোকটা বলল, “এটাতে অসুখ-বিসুখ করে না। তাই সারা পৃথিবীতে এটার দাম কম রে পাগলি।” তারপর হাসিটা মুখে মেখে রেখেই
লোকটা মেয়েটাকে দুটো দশ টাকার নোট ধরিয়ে সট করে কেটে পড়ল। আর হুড়মুড়িয়ে আরেকটা লোক
তিনটে মেয়েকে নিয়ে ঢুকে পড়ল। আগের মেয়েটা ঘর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। তিনজনে মিলে
পুরুষটার কাপড় জামা খুলতে লাগল, নিজেদেরগুলোও খুলতে লাগল। আর ঝুপ করে লোডশেডিং হয়ে
গেল। মফস্বলের এই এক দূর্গতি। কিন্তু দূর্গতি দেখা গেল শুধু লেখিকার। বারান্দায়
কোথাও থেকে জেনারেটরের আলো এসে পড়েছে। পাশের ঘরের সম্মিলিত হাসি আর শীৎকার সপ্তম
স্বর্গে। দড়াম করে দরজা খুলে মালকিন এসে বলল, “ঘরগুলোতে আলোর ব্যবস্থা নেই। তুমি
কী করবে?” লেখিকার ঘুম ধরে গিয়েছিল। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললেন, “একটা রিক্সা ডেকে দাও। লোকাল আছে। আমি বাড়ি চলে যাই।” মালকিন হাত ধরে লেখিকাকে সিঁড়ি
দিয়ে দোতলা থেকে একতলায় নামতে সাহায্য করল। তারপর “হরেন? গোপাল?” বলে ডাকাডাকি করল। তাতে যে রিক্সাটা এলো তার চালককে বলল, “দিদির থিকে বেশি ভাড়া নিবি না,
দিদি এনজিও তায় খগুরে কাগজ।” তারপর লেখিকাকে বলল, “আবার এসো। দুগ্গা, দুগ্গা।”
কথা মতো লেখিকাও পরের সপ্তাহে পৌঁছে গেলেন।
কিন্তু তখন মালকিনের ঘরে বেজায় চেঁচামেচি। একটা দালাল গোছের লোক নালিস করার মতো
করে বলছে, “এদিকে হাঁড়ির হাল, তায় উনি ধম্ম দেকাচ্চেন! আমাকে বলে কিনা ‘ইয়ের খ্যামতা নেই এক ঘর বিছানা!’...” দালালটি দম নিতে
থামল যেই অমনি মালকিন বলল, “এখন আয়, ভেবে দেখছি কী করা যায়।” তারপর মালকিন বিস্তর নাকে কান্না জুড়ল। তার সাথে নাকি মাস্তানের ঝামেলার জেরে ব্যবসা বন্ধ। একটা নাকি পুরোনো মেয়ে
আছে, যার বয়স হলেও দর আছে এখনও, কিন্তু তার নিজের উঠোন, ইঁটের দেয়াল আর টিনের চাল উঠতেই
সেই ধর্মে মন দিয়েছে। সকাল বিকেল ছবি আঁকিয়েদের সামনে কাপড় খুলে বসে থাকে, তাতে
খোরাকির পয়সাটুকু পেলেই সে সন্তুষ্ট। তো সেই মেয়ের কাছে দুর্দিনে সাহায্য চেয়ে
পাঠিয়েছিলেন দালাল মারফত, তাতে সে দালালের সাথে অমন করেছে। এতগুলো মানুষের পেট চলবে
কী করে ভেবেই মালকিন এখন অস্থির। লেখিকার উটকো গবেষণাকে ঔদার্য দেখানোর মতো
ঐশ্বর্য নাকি তার আর নেই, ইত্যাদি। তারপর আরেকটা ঠিকানা দিল সে ঘোর শহরের একটু
উচ্চমার্গীয় বারনারীর সাথে কথা বলার জন্য, শর্ত, “আমাকে কিন্তু টু পাস্সেন্ট দিতে
হবে।” লেখিকা জিজ্ঞেস করলেন, “কতো?” মালকিন ঘ্যাঁচ করে আলমারি খুলে একটা ক্যালকুলেটর বার করে বোতাম টিপে বললেন, “দু হাজার।” লেখিকা ব্যাগ খুলে দুটো কুড়ি
টাকার নোট বার করে বাড়িয়ে দিলেন। মালকিন বলল, “নেকাপড়ার এই ফল! বলি তেনার পারিশ্শমিকের
ওই টু পাস্সেন্টই দুহাজার।” ঠিকানাটা লেখিকার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। ভাবার ভঙ্গীতে মোবাইলের বোতাম টিপে
টিপে একটা মেসেজে লিখেও নিলেন সেটা। তারপর বললেন, “আমি পারবো না গো অত খরচ করতে।”
ওলোট-পালোট
শনিবার সারাদিন, রবিবার সারারাতেও যথেষ্ট সন্তোষজনক যৌনতা এলো না লেখায়। যৌনাচার
থেকে যৌনভঙ্গিমা যাই লেখেন সবই দেখতে পান কামসূত্র থেকে টোকা, বাৎসায়ন সেই
কয়েকহাজার বছর আগে লিখে রেখে গেছেন। এদিকে মোচড় ওদিকে মোচড় দিয়ে নতুন কিছু করতে
গেলেই মনে পড়ছে কলজে যে ছবিকে পানু বলে ডাকতেন সেসবের কথা। কুরুচির চূড়ান্ত সেসব
যে স্মৃতির এমন গভীরে রয়ে গেছে, লিখতে না বসলে তা কখনও টেরটি পেতেন না!
যৌনতা নিয়ে আবহমান কাল ধরে যে ব্যবসা চলেছে তার গতিপ্রকৃতির মতো তাত্ত্বিক কথা
বলতে বসে মনে হলো যে নারীদেহের এবং উত্তরকালে পুরুষ-নারী-অন্যলিঙ্গের সব
মানুষদেহের বস্তুকরণ ঘটছে এবং তাই নিয়ে আলোচনাটা এই মূহুর্তে ক্লিশে। তাহলে বেশ
নাড়িয়ে দেওয়া একটা ফিকশনও লেখা গেলনা, একটা সাড়া জাগানো তত্ত্বও তৈরি করা গেল না।
আঙুলের ডগায় রয়ে গেল কি-বোর্ড। একটা হেরে যাওয়ার কষ্ট গলার থেকে পাকস্থলীতে
কয়েকবার ঠেলে একলাখী বারনারীর নম্বরটা লাগানোর চেষ্টা করলেন লেখিকা। একটা যান্ত্রিক উত্তরব্যবস্থা বলল, “নমস্কার, ‘অবিরাম আনন্দ’-এর দূরভাষকেন্দ্রে যোগাযোগ করার জন্য ধন্যবাদ। আমাদের নিয়মিত
ব্যবসার সময় সোমবার থেকে শুক্রবার প্রতিদিন সকাল নটা থেকে বিকেল পাঁচটা। শনিবার,
রবিবার ও সংস্থার অন্যান্য বন্ধের দিনে আমাদের স্বয়ংক্রিয় উত্তরদাতাকে আপনার
প্রয়োজনের কথা জানাতে পারেন। আপনার যা বলার তা জানান বিপের পর।”
রকম সকম দেখে লেখিকা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। ভোর হতে তখনও ঘন্টাচারেক বাকি।
বিছানায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে ঘন্টা খানেক কেটে যেতে ভাবলেন যে যদি ভুল নম্বরে ফোন
করে থাকেন! খুব অভাববোধ করতে লাগলেন মোবাইলের যুগের আগেকার, কেবলমাত্র
ল্যান্ডলাইনের সময়টাকে। তখন কেমন টেলিফোন ডিরেক্টরি খুলে ফোন নম্বর থেকেই যাবতীয়
ঠিকানা এবং ঠিকানার মালিকটির নাম জানা যেত। আর এই হতচ্ছাড়া মোবাইলের যুগে কিছুতেই
বোঝার উপায় নেই যে হাতে টুকে আনা নম্বরের উল্টোপাড়ে কে আছে! হতে পারে মালকিনের
কাগজেই ভুল-ভাল লেখা ছিল। লেখিকা অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না যে মালকিনের
কাগজে ঠিকানাটা ইংরেজিতে লেখা ছিল না বাংলায়। যে সব অসভ্য অশিক্ষিতের আড়ত,
বাংলাতেই লেখা ছিল মনে হয়। নাহ্, অনেকগুলো মেয়ের বাচ্চারা তো ইস্কুলে যায়,
ঠিকানাটা বেশ স্পষ্ট হাতের লেখায় লেখা ছিল, বোধ হয়...। “দুচ্ছাই, নিকুচি করেছে...” বলে নিজের টুকে আনা নম্বর আর শেষ ডায়াল
করা নম্বর একবার তুলনা করে দেখলেন। দুটো অবিকল এক দেখে আবার ডায়াল করলেন। আবারও ‘অবিরাম আনন্দ’-এর যান্ত্রিক উত্তর রেকর্ড করার
ব্যবস্থার নির্দেশ শোনা যেতে লাগল।
সকাল হতে, আপিসের জন্য তৈরি হতে হতে একটা ফিকির মাথায় এলো। ‘অবিরাম আনন্দ’-এর যান্ত্রিক মেসেজ-এ জানালেন যে একটা
চালু পত্রিকার পক্ষ থেকে একটা ফিচার করার জন্য তিনি ‘অবিরাম আনন্দ’-এর কর্ণাধারের সাক্ষাৎকার প্রার্থী।
তারপর ‘মা ফলেষু কদাচন’ জপে নিজেকে সঁপে দিলেন সোমবারের গড্ডালিকায়।
দুপুর নাগাদ একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো। তিনি যেমন সদ্যজাত পত্রিকার
সম্পাদকের ফোন ধরে তাদের কৃতার্থ করেন, তেমন করেই ধরলেন ফোনটা। আর চমকে উঠলেন
শুনে, “নমস্কার, ‘অবিরাম আনন্দ’-এর থেকে চূর্ণা বলছি। আপনার নাম আর যে পত্রিকায় কাজ করেন তার নামটা বলুন
আরেকবার প্লিজ।” তোতলাতে তোতলাতে বলে দিলেন লেখিকা। চূর্ণা বলল ওঁরা ক্যালেন্ডার দেখে কয়েকদিন
পরে জানাবে। লেখিকা বিনবিনিয়ে ঘেমে উঠলেন এই ভেবে যে চূর্ণা কই জানতেও চাইল না যে ‘অবিরাম আনন্দ’-এর কাজের ব্যাপারে লেখিকা কতটা জানেন।
তিনি অবশ্য ঝালিয়েই রেখেছিলেন উত্তর, “প্রান্তিক নারীদের নিয়ে আপনাদের কাজের কথা সামান্য শুনেছি। সেসব বিষদে জানার
জন্যই যাব।” কিন্তু সেসব
কিছুই না ঘটায় তিনি বেশ ঘাবড়ে গেলেন।
তিন সপ্তাহ পরে একটা বুধবার কি বেস্পতিবার সকালে লেখিকা যখন বাসে বসে
উথালপাথাল মানুষের কথা, জীবনের কথা, সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কথা ভাবতে ভাবতে
ঢুলছেন, তখন তাঁর সেলফোনটা চ্যাঁ চ্যাঁ করে উঠল। ফোন ধরার ব্যাপারে যেহেতু
চেনাচেনা বাছ-বিচার নেই, তাই ঝপাং করে তিনি ফোনটা ধরেই নিলেন। চূর্ণা বলল, “সামনের রবিবার দুপুর একটায় আমাদের
আপিসে চলে আসুন। আমাদের সিইও আপনার সাথে কথা বলবেন। ঠিকানাটা আপনার জানা আছে বলেই
জানি।” ফোনটা চূর্ণা কেটে দিল। লেখিকার উত্তর দেওয়ার কোনো অবকাশ রইল না। এর মানে হয়
যে মফস্বলের মালকিনের সাথে এদের যোগাযোগ হয়েছে, তা হলে দেনা পাওনা? লেখিকা আবার
চূর্ণাকে ফোন করার চেষ্টা করলেন, ফোনটা কেবল ফ্যাক্সারে চলে যেতে লাগল। বাধ্য হয়ে ‘অবিরাম আনন্দ’-এর নম্বর লাগালেন। উত্তর এলো, “আমাদের সমস্ত উত্তরদাতা এখন ব্যস্ত।
বিপের পর আপনি আপনার নাম, ফোন নম্বর ও প্রশ্ন বা বক্তব্য রাখুন। যে ক্রমে আপনার কথা
আমরা শুনব, সেই ক্রমে আপনাকে উত্তর দেওয়া হবে।” লেখিকা আমতা, আমতা করে বললেন, “চূর্ণার সাথে আসছে রবিবারের মিটিং-এর কথা
পাকা হয়েছে বলে জানতে চাই, মিটিং-এর মাশুল কত? মানে মিটিং বাবদ আপনারা আমার থেকে
কত টাকা নেবেন? ফোনে না জানিয়ে মেসেজ করে দিলেও চলবে। ধন্যবাদ।” উৎকন্ঠার দুয়েক-রাত পেরিয়ে চূর্ণার
কাছ থেকেই টেলিফোনে জবাব এলো, “মিটিং বাবদ আপনার কোনো খরচ নেই।”
লেখিকা বিশ্বাস করতে পারছেন না। এমন হয় নাকি! যাদের রোজগার শরীর বেচে, তারা
কথা বলার জন্য পয়সা নেবে না? এদিকে এমন জব্বর যোগাযোগের কথা কারুর কাছে ফাঁস করতেও
ইচ্ছে করছে না তাঁর। কারুর সাথে আলোচনা করে সন্দেহগুলো ঝালিয়ে নিতে গেলেই যৌনতার
খোঁজে যে তিনি অন্যলোকের বিছানা দেখেছেন লুকিয়ে, ফ্রিতে এবং মূল্য দিয়ে সেসব কথা
ফাঁস হয়ে যাবে। আর তাঁর মান-সম্মান, সম্ভ্রম সব যাবে। নাম, ক্যারিসমা সব যাবে।
এদিকে তিনি নানা প্রশ্নে জেরবার। একলাখী বেশ্যাকে কী সাব-অল্টার্ন বলা যায়? না
বলা গেলে কেন যায় না, কিংবা তার সাথে নিপীড়িত, শোষিত, নির্যাতিত, অসংখ্য দারিদ্র্য
ক্লিষ্ট নিঃপাই প্রান্তিক যৌনকর্মীদের তফাতটাই বা কী? এঁদের সাথে ওঁর মূল্যের তফাৎটা
কেন? কৌতুহলে সাঁতার দিতে দিতে রবিবার দুপুরে তিনি হাজির হলেন অ্যালপাইন হাইটসের
দরজায়। ডোরবেল বাজল যেন গীর্জার ঘন্টা! এ কী পরিহাস? উত্তর পাওয়ার আগেই কুড়ি ফুট
উঁচু দুপাল্লার দূর্গফটকের মতো দরজার পাশে ছোট্টো একটা ফুট সাতেক উঁচু দরজা খুলে
গেল। দরজাটা না খুললে, ওটাকে দেওয়ালেরই অংশ বলে ধরে নেওয়া গিয়েছিল। লেখিকা ঢুকলেন
একটা আট ফুট বাই আট ফুট কুঠুরিতে। একটি বিশ-পঁচিশ বছরের মেয়ে এসে তাঁর ঝোলাটাকে একটা মোটা কাপড়ের থলিতে ভরে দিল।
থলির ভেতরের দেওয়ালে কালো কাপড়ের আস্তরণ। তারপর লেখিকাকে একটা আলখাল্লা পরতে বলল,
যার ভেতরে কালো কাপড়ের আস্তরণ। তারপর মেয়েটা লেখকের কানের দুলে, চশমার ফ্রেমে,
ব্ল্যাকটেপ লাগিয়ে দিল, ঝটপট। তারপর বলল, “সেলফোনটা অফ করে ভরে দিন এই বাক্সে।” বিরক্তিকর এই ব্যবস্থা চলাকালীন
লেখক নজর করলেন মাটিটা একটু কেঁপে উঠল। তারপর শুনলেন গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট হওয়ার
শব্দ। দেওয়ালের গায়ের কাচ ঢাকা চৌকো জানলা দিয়ে দেখলেন একটা গাড়ি বেরিয়ে যেতে
মেঝেটা পাতালে চলে গেল, আর একটু পরে আবার অল্প মাটি কাঁপিয়ে উঠে এলো আরেকটা গাড়ি
নিয়ে। মানে এই বাড়ির নিচে মলের পার্কিং-এর মতো পার্কিং আছে!
মেয়েটার কথায় চমকের ঘোর ভেঙে গেল তাঁর। শুনলেন, “বলছি যে বাক্সটা ঝোলায় পুরে নিজের
কাছে রাখুন।” তিনি নির্দেশ মেনে নিলেন। তারপর আবারও মেয়েটার নির্দেশেই তাকে অনুসরণ করলেন।
দেউটি পেরতে পাইন ছাওয়া ঠান্ডা ছায়া দিয়ে মোড়া গলিপথ। তারপর গাছ দিয়ে সাজানো বারান্দা টপকে ঢোকা গেল বসার
ঘরে। ঘরটা দাবার ছকের মতো সাজানো। সব আসবাবে, মেঝেতে, ছাদে দাবার কেরামতি। সেখানেই
পাটভাঙা ডুরে শার্ট আর কালো প্যান্ট, কালো পাম্প শু পরা আরেকটা বছর বিশ-পঁচিশেকের
মেয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করল, “আসুন, বসুন। চা বলি?” লেখিকার অবিশ্বাসের পাহাড় ঠেলে কোনো মতে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলেন। মেয়েটি বসতে,
তিনিও বসে পড়লেন। এতো কেতাদুরস্ত আবহাওয়া তিনি কল্পনাই করতে পারেন নি। মেয়েটিই
প্রথম মুখ খুলল, “বেবাক হয়ে গেলে ফিচারের জন্য প্রশ্ন করবেন কী করে?” লেখিকা যিনি স্বভাব বাকপটুতায়
প্রচুর পুরস্কৃত তিনি হাঁ করলেন কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। তখন মেয়েটিই আবার বলল,
“নাকি আপনার জিজ্ঞেস করার কিছু নেই
যেহেতু আপনার প্রস্তাবটা হলো আমার ব্যবসার মূল পরিষেবাটা উঁকি দিয়ে দেখে একটা হইচই
জাগানো গল্প লেখা, যেটা পুরস্কারও পাবে, ফিল্মও হবে, নাম হবে, মান হবে, পয়সাও
হবে......”
আক্রান্ত হতেই লেখিকার জান্তব প্রতিরক্ষা প্রবণতা জেগে উঠল, “তার মানে আপনিও আমার পিছনে
লোক......” হা হা হেসে উঠল মেয়েটি। হাসি শেষ হতে বলল, “আপনার লেখায় চোখ বুলিয়ে আপনাকে
চালাক চতুর মনে হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিমতী বলতে যা বোঝায় সেটা যে আপনি নন তার প্রমাণ
পেলাম।” আহত লেখিকা আবার ফণা তুললেন, “আমার লেখা পড়ে তুমি বুঝবে কী?” মেয়েটি মুখের হাসিটা ঝকঝকে রেখেই বলল, “ইন্টেলেকচুয়াল সুপিরিয়রিটির প্রশ্ন
করছেন? আপনি তো মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক বিএ এম এ-র বাইরে গ্লোবাল কোনো মাপকাঠিতেই
পরীক্ষা দেন নি। তাও আবার যে শিক্ষাব্যবস্থায় ডিগ্রি কেনা যায়-” লেখিকা মরিয়া হয়ে গজগজ করলেন, “আমাদের যুগে সেসব-” মেয়েটি বলল, “একালের মতো ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ খোলামেলা বেচাকেনা ছিল না, কিন্তু
চোরাগোপ্তা ট্যাবিউলেটরকে পয়সা দিয়ে স্কোর কিনে, যদি মার্কশিট বেরোলে ক্ষতিগ্রস্ত পরীক্ষার্থী
মামলা করে তো তার খাতা লোপাট করে হাজির করার মতো প্রমাণ গায়েব করার চল তো ছিল। তো
আপনাদের ডিগ্রিগুলো মূল্যহীন, সেগুলো ইন্টেলেক্টের মাপকাঠি নয়। আর লিখে-টিখে যে ঢাকটা পেটান সেটা কতটা সময় ধরে কাদের
সাথে, কোন কোন দলে ভিড়ে ঢাক পিটছেন তার ওপর দাঁড়িয়ে, ইনলেক্টের সাথে তার কোনও
সম্পর্ক নেই। এসবের এক্কেবারে উল্টোদিকে আমার ব্যবসাটা। এর ইউএসপি হচ্ছে চুপচাপ থাকা, আপনাদের মতো সোশ্যাল,
আনসোশ্যাল, অ্যান্টিসোশ্যাল, কর্পোরেট বা কো-অপরেটিভ মিডিয়ায় ঢাক পেটানো নয়। তাই
আমার এসএটি স্কোর ষোলশো না চব্বিশশো, জিআরই নাইনটি ফাইভ পারসেন্টাইল কিনা সেসব
আপনাদের জানার কথাও নয়। জানেন না বলে মানেনও না। আসলে যে টুপিটা মাথায় পরে আছেন, সেটাকেই খুলি ভাবেন ড়
ভেতরের হাওয়াটাকে ঘিলু-”
লেখিকা মুখ বাঁকিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, “নিজের ডেরায় ডেকে অপমান করাটা দূর্বলতা।” মেয়েটি এবার অট্টহাস্য করে উঠল, “তাহলে আপনি কী বলেন, আমার ডেরায় এসে আপনি আমাকেই অপমান করে জোর দেখাবেন, আর সেটাই
বুদ্ধিমত্তা? আমার লোকজন সদরে না পৌঁছে দিলে, আপনি বেরোবেন কি করে এখান থেকে?” এরপরের নৈঃশব্দটা লেখিকা ভরতে
পারলেন না। কপালে ঘামের বিনবিনিয়ে ওঠাটাও লুকোতে পারলেন না। মেয়েটির হাসিমাখা
সপ্রশ্ন চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে বিনা পয়সায় আমাকেই বা সময় দিচ্ছেন কেন?” মেয়েটি হাসি ধরে রেখেই বলল, “গুড কোয়েশ্চেন। সময় আপনি দিচ্ছেন,
ফোকটে। আপনি নিজের নাম আর পত্রিকার নাম বলে যোগাযোগ করায় আমাদের জন্য আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড
চেক করা সহজ হয়ে যায়। আপনার আর্টিক্ল আছে, ফিচার নেই - আপনি পত্রিকায় স্টাফ নন, ফ্রিলান্সার, জীবিকা
চাকরি, শখ আঁতলামি - কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না আঁতলামির ফ্যাশনেবল ডেস্টিনেসন্স্
যেমন খালাসিটোলা, হাড়কাটাগলি সেসব ছেড়ে
কেন আপনি ‘অবিরাম আনন্দ’-এ। সংসারের দায়িত্ব নেবেন না স্ত্রী-স্বাধীনতার অছিলায়, সেই অছিলাতেই একাধিক
বিবাহিতাবিবাহিত পুরুষের সাথে, মহিলার সাথে প্রেম করার সুখটুকু নেবেন, কিন্তু সংসারের
দায়িত্ব কিছু নেবেন না - এবং আপনি এই বয়সেও চান লোকে আপনাকে ‘ভালো’, ‘সংবেদনশীল’ ‘সমাজসচেতন’ বলুক। ফলে যাপনজনিত মর্যাল ডিলেমায় জর্জরিত হয়ে একশো বছরের পুরোনো তত্ত্ব
ঝেড়ে নিজের ইন্টেলেকচুয়াল সুপিরিয়রিটি দাবি করে চলেছেন, যদিও বুঝতেও পারেন না
তত্ত্বটার বৈজ্ঞানিক ভুল। আবার আর্টিক্ল আর ফিকশনে যৌনতার অভাব বলে ‘অন্য’ লোকে খুঁত ধরায়, সেই লোকের বিচারে
একশোয় একশো পাওয়ার চেষ্টায় যৌনবাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন - এরকম স্নায়ুগিঁট আমাদের
একঘেয়ে জীবনে দারুন এন্টারটেইনমেন্ট, ম্যা-ম। আপনাকে ছাড়ি কী করে!” আক্রান্ত, আহত লেখিকা এবার
আক্রমণই সেরা রক্ষণ বলে মনে করলেন, “বেশ তো, আমি অন্য নারীপুরুষের, এমনকি যারা একগামিতার শপথ নিয়েছে, তাদেরও
যৌনজীবনে ভাগ বসাই, সেই নারীপুরুষেরা যৌনতার বদলে যৌনতা পায়, আমিও তাই পাই তাতে
আমারটা অপরাধ হলো, আর তোমার পয়সার বিনিময়ে যৌনতা বেচাটা নৈতিক?”
মেয়েটি পুলকিত, উল্লসিত হয়ে উঠল, “আপনি যাদের যৌনজীবনে ভাগ বসান, তারা যৌনতার বিনিময়ে যৌনতা দেয়, উপরি দেয়
গার্হস্থ্য, সন্তানসুখ, নিশ্চিত করে একটা প্রজাতির জৈবিক এবং নৈতিক টিকে থাকা।
আপনি তো উপরি কিছু দেন না, উল্টে তাদের স্টেডি পার্টনারদের প্রাপ্য যৌনতায় ভাগ
বসিয়ে তাদের পার্টনারদেরকে বঞ্চিত করেন প্রাপ্য যৌনতা থেকে, মানে আপনার প্রেমিকদের
স্টেডি পার্টনাররা যৌনতার বিনিময়ে প্রাপ্য যৌনতাটুকুও পায় না! আবার আপনি আপনার
যৌনসঙ্গী এবং সঙ্গিনীদের সারাক্ষণ ভয়ও দেখাতে থাকেন যে আপনার সাথে যৌনতা বিনিময় না
করলে আপনি নাকি সব ফাঁস করে দিয়ে তাদের সুখের স্বর্গে আগুন দিয়ে দেবেন! ইন্সিকিউরিটির
হদ্দমুদ্দ।” একটু থেমে মেয়েটা আবার বলল, “আমি পয়সার বিনিময়ে যৌনতা দিই না। যৌনতার সাথে যৌনতা বিনিময় করি। পয়সাটা সেই
বিনিময় গোপন রাখার মাশুল। আপনাদের সমাজ বাড়ির
রান্না ফেলে রেস্টুরেন্টে খেলে নিন্দে করে না, কিন্তু বাড়ির যৌনতা থেকে একটু স্বাদ
বদলের জন্য বাইরে যৌনতা করলে দোষ ধরে। আইন বানিয়ে ক্রিমিনাল অফেন্স ধরে। তাই আপনি
লোকের অপরাধবোধের সুবিধা তোলেন, আর আমি লোকের অপরাধবোধটাকে পয়সার বিনিময়ে অবলিভিয়ন
বা বিস্মৃতি নামের কুঠুরিতে রাখি। তফাতটা বুঝলেন?”
লেখিকা তফাত বুঝতে আসেন নি ‘অবিরাম আনন্দ’-এ কিংবা অ্যালপাইন হাইট্সে। তিনি এসেছিলেন রগরগে যৌনতার খোঁজে, যাতে মুড়ে
খানিকটা খসখসে দুঃখ আর ঢকঢকে বঞ্চনা দিয়ে প্রবল আবেগঝঞ্ঝা ঘনিয়ে তোলা যায়,
জনপ্রিয়তা আর প্রশংসা দুই-ই হাসিল করা যায়। ম্যাগো, ফিচার লিখবেন তিনি কোন দুঃখে!
তাঁর কী কল্পনার দৈন্য নাকি সত্য আর তথ্যের অভাব? ফলে ধৈর্য ধরে রাখার কোনো দরকারই
তাঁর ছিল না। মেয়েটার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলে বসলেন, “জানো, আমি উত্তমনারীতে নিজের
অভিজ্ঞতার নামে তোমার এবং তোমার মতো মেয়েদের ব্যবসার কথা নিয়ে আর্টিক্ল লিখে
তোমাদের লাটে তুলতে পারি?”
মেয়েটির উত্তরুৎসুক মুখে আবার কৌতুক
জমে উঠল। বলল, “শুনেছেন বা পড়েছেন কখনও মার্গারেট থ্যাচার বলেছিলেন, ‘বিয়িং পাওয়ারফুল ইস লাইক বিয়িং আ
ওম্যান। ইফ ইউ হ্যাভ টু সে ইউ আর, উ আরন্ট।’ ক্ষমতা দেখাচ্ছেন? বেশ তো লিখুন আর্টিক্ল, নিজের
ব্লগ ছাড়া আর কোথাও পাবলিশ করা যায় কিনা দেখুন, দেখুন ব্লগের ভিজিবিলিটি ব্লকড হয়ে
যায় কিনা। আপনার চুলের ডগা না ছুঁয়েও, আপনার শরীরে, পোশাকে রেকর্ডিং ডিভাইস লুকিয়ে
রাখার সম্ভাবনাটাই অকেজো করে দিয়েছি,
আপনাকে জোব্বা পরিয়ে, আপনার মাথায় উরনি বেধে, আপনার ঝোলা আমাদের ঝোলার মধ্যে পুরে।
এমনকি আপনার মোবাইলটা অবধি এখন ‘পরিষেবা সীমার বাইরে’। এই কথাবার্তার কোনো জার্নালিস্টিক প্রুফ রাখতে
পারবেন না, ম্যাম। এর থেকে হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন যে আপনার ব্লগটা যাতে কেউ না
পড়ে তার ব্যবস্থা করতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না।”
লেখিকার অভিপ্রায় সিদ্ধির সম্ভাবনা গেছে দেখে তিনি আর একটা মরিয়া চেষ্টা করলেন। “তোমার ব্যবসাটা তো বেআইনি।” মেয়েটা এবার ফিক করে হাসল, “যারা আইনের রক্ষক, যারা আইনের ব্যবসাদার, যারা আইন বানায়, যারা আইন ভাঙে তারাও
আপনারই মতো এখানে এসে ক্ষমতা দেখিয়ে যায়। কিন্তু ক্ষমতায় কুলোলে বিবেচনা করে
দেখবেন কে বেশি ক্ষমতাবান – যে কোটি কোটি লোককে বুদ্ধু বানিয়ে প্রধানমন্ত্রী হলো বা মুখ্যমন্ত্রী হলো সে,
নাকি যে লোকটা সেই মন্ত্রীর ক্ষমতার তম্বি উপভোগ করতে করতে তাকে অরগ্যাজম ফেক করে
সে।”
এবার লেখিকার ঠোঁটে একচিলতে জয়ের হাসি দেখা গেল। যা হোক মেয়েটার এতো যত্নে
সামলে রাখা খদ্দেরদের গোপনীয়তায় চিড় ধরানো গেছে। তাই মেয়েটিও একটু সতর্ক হলো। বলল,
“চা-তো ঠান্ডা হয়ে গেল, আরেক কাপ
বলি?” লেখিকা বললেন, “না, আমার আর চা-এর দরকার নেই। আপনি অনুমতি দিলে আমি যেতে পারি।” মেয়েটি এবার নির্লিপ্তি নিয়ে বলল, “যা খুশি লিখুন। তবে যদি বলেন যে
আমাদের ব্যবসায় যারা পরিষেবা দেয় তারা নিতান্ত অবস্থার স্বীকার, সেটা ডাহা মিথ্যে
বলা হবে। বেশ্যাবৃত্তির ইচ্ছে না থাকলে আত্মহত্যা করা তো কারুর আটকায় না। যেমন
আপনি না চাইলে কেউ আপনাকে দিয়ে রগরগে কিংবা গ্যাদগ্যাদে গা-গুলানো যৌনতা লেখাতে
পারে না। ভালো থাকুন। নমস্কার।” যে মেয়েটি সদর থেকে ভিতরে নিয়ে এসছিল লেখিকাকে, সে ততক্ষণে উপস্থিত হয়েছে
দাবার ছকের ভিতরে। তাই লেখিকাও উঠে পড়ে জোব্বা-ঝোলা-বাক্স-ব্ল্যাকটেপ থেকে মুক্তি
নিয়ে, হিমশীতল অ্যালপাইন হাইট্স থেকে বেরিয়ে পা রাখলেন শহরের রোদ চিড়বিড়ে ঘেমো
ভিড়ে।
সঙ্কটমোচন
একটা ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে হাঁটছিলেন ফুটপাথ ধরে।
ব্যাগের মধ্যে ফোনটা কাঁপছে। তাঁর এখন ধরতে ইচ্ছে করছে না। এতটুকুও যৌনতা তিনি
কোত্থাও পেলেন না, যেটা লিখে তিনি হুলুস্থুল করে ফেলতে পারেন। বেশ হতাশ হয়ে
বহুমাথা মোড়ে লঞ্চঘাটগামী একটা অটোরিক্সায় চড়ে পড়লেন। তাঁর পাশে একটা মেয়ে বসে। মেয়েটার গা ঘেঁসে একটা পুরুষ। পুরুষটা বলল, “পাঁচশো? পাঁচশো বড্ড বেশি।” মেয়েটা কিছুই বলল না । লোকটা বলল, “আড়াইশো?” মেয়েটা তাও কোনো জবাব দিল না। লোকটা আবার বলল, “তিনশো?” মেয়েটা এক্কেবারে নিঃশব্দ। ফের লোকটা
ঘড়ঘড়ে গলায় “সাড়ে তিনশ।” বলে মেয়েটার উরুটা খামচে ধরল। মেয়েটা শাঁখা-পলা-কাচের চুড়ি-ইমিটেশন চুড়ি সমেত
হাত দিয়ে লোকটার কবজিতে একটা মোচড় লাগাল। লোকটা “আহ্হ্” বলে মেয়েটার উরু ছেড়ে দিল।
মেয়েটাও লোকটাকে ডিঙিয়ে অটোর জঙ্গলের মধ্যে নেমে গেল, বেশ গম্ভীর চালে। লোকটা
উস্কো-খুস্কো চেহারায় অটোওলাকে আট টাকা খুচরো দিয়ে নেমে গেল। লেখিকা ফাঁকা অটোয়
একান্তে সেলফোন খুলে দেখলেন। সম্পাদকের ফোন, পাঁচবার। একটা মেসেজ, “কোনো নারী উদ্যোগ নিয়ে কিছু দেবেন
না প্লিজ। একথা বলছি কারণ আপনি যে ‘অবিরল সাধনা নারী উন্নতি মন্দির’-এর নানান আপিসে যাতায়ায় করছেন সেটা আমি জানি। ওদের নিয়ে রোজ বিদেশি পুঁজিতে
চালু ইংরেজি কাগজগুলো দশ বছর ধরে লিখে চলেছে, আমরা কখনও লিখিনি বলে। আমরা আমাদের
পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ। আমরা যা চিরকাল ছেপেছি তাই ছাপব, কাউকে কিছু করতে দেখে আমরাও
সেটাই করার জন্য ঝাঁপাই না। আমরা অরিজিনাল ভাবি, তাই সব্বার থেকে সবসময় এগিয়ে
থাকি।”
লেখিকার কানটা গরম হয়ে গেল! ‘অবিরাম আনন্দ’ হোক বা অ্যালপাইন হাইট্স, নাকি ‘অবিরল সাধনা নারী উন্নতি মন্দির’ তার খবর দশ বছর ধরে ইংরেজি কাগজের
পাঠকরা জানে! কেবল তিনিই জানেন না! কথাটা যত ভাবছেন, তত জ্বলছেন তিনি রাগে। শেষে
ফাঁকা, চুপচাপ লঞ্চঘাটে বসে সম্পাদকের নম্বরটা ডায়াল করলেন। সম্পাদক কিচ্ছু শোনেন
না, শুধু বলেন। তাই ফোন তুলেই বললেন, “এটুকু বলুন শুধু আগামী ইস্যুতে চারটে পাতা মানে হাজার দুয়েক শব্দের জায়গা রাখব
কি আপনার জন্য?” অন্য কালে হলে লেখিকার অহংটি লাফিয়ে আকাশ ছুঁতো এই ভেবে যে হু হু কাটতি
পত্রিকার সম্পাদক তাঁর লেখা শুরু হওয়ার আগেই তাঁর জন্য জায়গা রাখতে চাইছেন পরবর্তী
সংখ্যায়, এ যেন স্বর্গের নন্দনকাননে স্বয়ং ইন্দ্র বাংলো অফার করছে! কিন্তু
মফস্বলের খারাপ পাড়া থেকে শহুরে আলিশান অ্যালপাইন হাইট্স ঘুরেফিরে তাঁর গিঁটগুলো
খুলে গেছে। তিনি আর তেমন ভালো লিখতে পারবেন কিনা কিংবা আদপেই কখনও লিখতে পারবেন
কিনা তাই নিয়ে তাঁর ঘোর সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এই সমস্ত বেঁচে থাকার মধ্যে
সত্যিমিথ্যে মিশিয়ে মনকে চোখ ঠারা কথায় সাজানো যে পৃথিবীটা গড়েছেন তার সবটাই
ফালতু, মূল্যহীন, মেকি বলে মনে হচ্ছে। এই গড়নে নিজেকে ওস্তাদ কারিগর ভেবে বহু বছর
ধরে আহ্লাদ করাটা মুর্খামি বলে মনে হচ্ছে। নিজের নির্বুদ্ধিতা আর অপদার্থতা টের
পাওয়ার লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। আর এসবের মূলে এই হারামী, শালা সম্পাদক! তাই
উত্তরে লেখিকা বললেন, “মর মিনসে, ওলাওঠা হয়ে মর!”