Wednesday, August 21, 2024

Some Wariness

 


২০০৮ সবে সবে উর্দি (অসামরিক) ছেড়ে খাঁটি সভ্য/ শিষ্ট/ নাগরিক/ বেসামরিক ধাঁচের একটা সরকারী কাজ করতে শুরু করেছি। বাসে চড়ার সময়ে আর  বাস থকে নামার সময়ে ভিআইপি-কেস্টোপুর মোড়ে বা উল্টোডাঙার মোড়ের পাঁচটা মাথায়, বারাসাত কলোনি মোড়ে উর্দিহীন ডান্ডাবাজদের প্রবল পরাক্রমে বাস আর ট্রাক পেটাতে দেখছি, রিক্সা ঠেলা অমোটরচালিত যানগুলোকে তাড়া করতে দেখেছি। দেখেছি কখনও কখনও উর্দি পরা লোকেরা কাজটা করছে উর্দিহীনদের সাথে একজোটে।

কৌতুহল আটকাতে না পেরে বারাসাত কলোনি মোড়ে এক ডান্ডাবাজকে জিজ্ঞেসই করে ফেলে ছিলাম, “এটা কী আপনার কাজ? নাকি শখ?”

বলে ছিলেন, “কাজ। মিউনিসিপ্যালিটির। সপ্তায় পাঁচদিন দশ ঘন্টা করে ডিউটি করলে হাজার টাকা।”

মিউনিসিপ্যালটির ট্র্যাফিক পুলিশ? হতে পারে কি? সে যাবৎ যা আইন ছিলো তাতে?

আইন যাঁরা বানান আইন সভায়, তাঁরা নির্বাচকদের ইচ্ছে পূরণ করতে চান বলেই নাকি আইন বানান।

আদালত আইন অনুসারে বিচার করে, এমন কি আইনেরও বিচার করে। সরকারী দপ্তর আইন লাগু করে, উর্দি থাক বা না থাক। 

অর্ধদশক ধরে সরকারী দপ্তরের ঝাল খেয়ে, ঝড়ঝাপটা সয়ে ভেবে ছিলাম, “বেআইনি হলেও কদিন পরে আইন বানিয়ে নেওয়াই যায়। আপাতত তো রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজে এদের লাগানো হয়েছে বলে দেখালেই চলবে মিউনিসিপ্যালিটির খরচের খাতায়। অনিয়ম, বেআইনি কিছুই ধরা পড়বে না।”

আপন মনে বাঁকা হাসি নিয়ে নিজের বিশ্লেষণের তারিফ করতে করতে কলকাতা শহরের মোড়ে আবার এক ডান্ডাবাজকে ধরলাম। তিনি বলে ছিলেন তাঁর নিয়োজক পুলিশ, তবে টাকাটা একই পরিমাণ পান। শহর বলে বারাসাতের এক হাজার টাকা বারোশো টাকা হয়ে যায় নি।

আপন মনের বাঁকা হাসি আটকাতে পারি নি। বাহ্‌ রে, উর্বর মস্তিষ্ক রাজনীতিক আর তার গুন্ডাবাহিনী! 

ধর কিনা রোজ সকালে ডান্ডাহাতে সে থানার নির্দেশে বাস ঠেঙালো উল্টোডাঙায়, আর সন্দেশখালির পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগের দিন বলে গেল, “টাকা-ফাকা কাটবেন না বড়োবাবু, কাল যদি জ্যান্ত থাকি, তবে পরশু এসে ডিউটি করবো।”

অন্তত আমি যেখানে কাজ করতাম সেখানে দিনমজুর থেকে চতুর্থ শ্রেণীর সরকারি কর্মী হয়ে যাওয়া মানুষেরা তো আমাকে অমন করেই চমকে দেবার চেষ্টা করতো।

কেবল ভাবতাম জনসুরক্ষা বাহন নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটা কী এতোই সস্তা?

২০১১। কলকাতা পুলিশে কর্মরত এক বন্ধুও কথাটা চায়ের আড্ডাতে বলে ফেললেন। 

২০১৮। হাওড়াতে ক্যারি রোড থেকে যে রাস্তাটা পদ্মপুকুর রেলওয়ে ক্রসিং হয়ে আন্দুল রোডে পড়ছে, তার ক্যারি রোড প্রান্ত ক্যামেরাখচিত, আন্দুল রোড প্রান্তে একটা পুলিশ ব্যারাক আছে কিন্তু কোনো ক্যামেরা নেই। সিভিক ট্র্যাফিক ভলান্টিয়ার ঐখানে মুর্গি বওয়া পিক আপ ট্রাক থেকে তোলা/ঘুষ নগদে নিচ্ছে, দরাদরি চলছে দরাজ। দুপুর বেলা। টাকার পরিমাণ চূড়ান্ত হওয়ার আগে সিভিক ট্র্যাফিক ভলান্টিয়ার সেটা যাচাই করে নিলো শিক্ষকের ভঙ্গীতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রেডিও সেটে কথোপকথনে ব্যস্ত উর্দিপরা সরকারি বেতনভুকের থেকে।

পুরো কলকাতা বিধাননগরে আট হাজার টাকা মাসমাইনের সিভিক ট্র্যাফিক ভলান্টিয়ারের ফ্যাকাসে উর্দি আর চমকিলা মোটরবাইকে নজর আটকে যাচ্ছিল। কারটা সততার বেতনে, ব্যাঙ্কের কাছে ধারে আর কারটা তোলাবাজির পয়সায় বোঝা মুস্কিল। সমাজ ব্যাপারটাই তো অনন্ত ঘোলা জল! অতএব এতো কথা বলার কী দরকার?

২০২৪। উবার ড্রাইভার বললো রফা হলে টাকাটা নবান্নর নিচে ছাতুর সরবত বেচে যে লোকটা তাকে দিয়ে দিতে হয়। রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দার কোণে কোণে পান-বিড়ি সিগারেটের দোকান, বিকাশভবনের সিঁড়ির কোণে ঘুগনি রুটি চায়ের দোকানে ঘুষ/তোলা সংগ্রাহকদের নিজের চোখে দেখেছি। তাই নবান্নর নাকের ডগায় ছাতুর সরবতের কথাটা চোখে না দেখলেও, সয়ে নিলাম।

মানে যদি পুরো বিত্তব্যবস্থা একশোভাগ নগদহীন (ক্যাশলেস বলছি) করে ফেলাও যায়। তাতে সারা দিনে ছাতুওয়ালার পাঁচ গ্লাস শরবত বিক্রি হলে সেটাকে পাঁচ হাজার গ্লাস বিক্রি বলে চালানো যায়, তার দোকানে রাখা কয়েক ডজন কিউআর কোডের একেকটা একেক সরকারী বেতনভুকের, তাদের একেক জনের মায়ের, বউয়ের বা বরের, বোনের, ভাইয়ের, ভাইয়ের বউয়ের, বোনের বরের, মামার, মামার ভায়রাভায়ের, পিসের পিসের পিসতুতো ভাইয়ের - আর যতো লোকের হতে পারে সবার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যুক্ত হলে, এতগুলো লোক কে কাকে কতো দরে তোলা বাজির অংশ দেবে সেটা বোঝাপড়া হয়ে গেলে, কতোগুলো প্যান-আধার সম্বলিত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের লেনদেনের ওপর নজরদারি করার সময় বা খরচবহন করার ক্ষমতা কার আছে, তাও যদি প্রত্যকটা লেনদেন খুব কম নয়, দু লাখ টাকার কমে খুব খুচরো পরিমাণে হয়?

এই ব্যবস্থাটা একটা সর্বব্যাপী সুদুরপ্রসারী সরকারী-বেসরকারী যৌথ ব্যবসা (পাব্লিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ [পিপিপি])- এ র উদাহরণ ছাড়া আর কী?

নৈতিক চরিত্রটা যেহেতু ঝামা পাথর সেহেতু মাথাটা খুব ব্যাসল্টের মতো (নোড়ার মতো) নিরেট না হলে গোলোযোগ আর যোগাযোগ দুটোই বোঝা খুবই সোজা।

ভুলি নি তো কাউকেই - নির্ভয়াকে, কামদুনির টুম্পাকে, সুসান রডরিগেজকে, তাপসী মালিককে, তারও আগে খবরের কাগজের পাতা জুড়ে গ্রাম বাংলার মাঠে ময়দানে পড়ে থাকা যে সব অনামী নির্যাতিতা নাবালিকা আর সাবালিকাদের কথা লেখা হতো তাদের, ভাবেরি (ভানওয়ারি) দেবিকে, রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিপোর্টে ছাপা আফ্রিকার কোণে কোণে কুঁকড়ে থাকা নারীদের আর পুরুষদের, পুঁজিবাদী টিভি কোম্পানির তথ্যচিত্রে দেখা আমাজনের জঙ্গলে আর আন্দিজের খাঁজে থাকা নারীদের,আর হ্যাঁ, পুরুষদের  ……… 

তাতে কী? নির্ভয়ার পরে ভারতীয় দন্ড সংহিতা (ইংরেজি থেকে সংস্কৃত ধোওয়া যেকোনো ভাষাতে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডটা অমনই দাঁড়ায়) -তে ধর্ষণের ধারা বিশদে বদলে ফেলা হয়েছে খুব কম সময়ে, নির্ভয়ার অপরাধীরা সাজাও পেয়েছে, তবুও ধর্ষণের ধারা অব্যাহত।

যদিও দিল্লি পুলিশের কাছে নাকি তথ্য আছে কোন এলাকায় কী হারে কতো পুরুষ ধর্ষিত হয়, তবু ব্যাপারটা মেয়েদের ফুটবলের মতো রয়ে গেছে। হয় নাকি? হয় বুঝি? তবে তেমন বিকোয় না তো - 

ক্ষমতা দেখাতে একটা শরীরকে কষ্ট দিলে, একটা জীবনকে শেষ করে দিলে যদি তুষ্টি মতো সাড়া জাগানো যায়, গণমাধ্যমে নাম ও চেহারা প্রচারিত হয়ে নিমেষে সারা পৃথিবীর সাতশো কোটির ভগ্নাংশেরও মনে জায়গা করে নেওয়া যায়, সেটা ঘেন্না হোক আর প্রীতি হোক, পরিচিতি তো বটে। সেটা ক্ষমতার দৌড়ে একটা মস্ত পিক-আপ, ধাঁ করে অ্যাক্সেলেটরে এক চাপে অনেক দূর -

২০১৬-র পরে, ২০২০-র আগে যে সরকারী হাসপাতাল এসিয়ায় সেরা সরকারী স্বাস্থ্যপরিষেবার জন্য পুরস্কৃত বলে তোরণ বানায়, সেখানে কোণে কোণে সারভেইল্যান্স ক্যামেরা নেই? স্পষ্ট দপ্তর আছে তো যৌননিগ্রহের অভিযোগ জানানোর? আসলে তোরণ বানাতে যে সিমেন্ট লাগে সেটা যদি দু বস্তা হয় তবে দুশো বস্তার রসিদ কেটে তোরণের বানানোর কাজে যারা যুক্ত তারা সবাই মিলে টাকাটা ভাগ করে নিলে কেমন হয়? হলো না খাসা পাব্লিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)? সেই জন্যই উন্নয়নের নামে রাস্তা হয় আর তোরণ হয়, নৈতিক চরিত্র বানানোর জন্য পড়ে থাকে ঝামা পাথর।

ওটা দিয়ে কিচ্ছু পরিষ্কার করা যায় না। 

পরিষ্কার করতে গেলে রাস্তার ওপর থেকে ঠেলা, ছাতার তলার দোকানগুলো তুলে দিতে হবে, সমস্ত দোকান কেবলমাত্র নির্ধারিত বাজারে আবদ্ধ করতে হবে। বড়ো রাস্তার ওপরে যে লোকেরা বাজার বসায়, তাদের বাজার বসানো বন্ধ করতে হবে, সমস্ত নির্মাণ প্রকল্প, যতো খুচরোই হোক না কেন, অনলাইন পাব্লিক বিডিং-এ নিয়োগ করতে হবে। আইন করতে হবে অন্তত সাত বছরের জন্য সমস্ত নির্মাণ প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণের দায় নির্মাণের কাজ যে সংস্থা করবে তাদের। আর সার্ভেইল্যান্স ক্যামেরা কিংবা পেটসিটি মেসিন সরকারী হাসপাতালে যে যন্ত্রই কেনা হোক না কেন তার সাময়িক রক্ষণাবেক্ষণের চুক্তি (যেমন অ্যানুয়াল মেইন্ট্যানেন্স কন্ট্রাক্ট)-র ও চুক্তি নবীকরণের ব্যবস্থা বার্ষিক খরচের (বাজেটে) বরাদ্দ করতে হবে। 

না হলে যতোই ডিমনিটাইকজেসন হোক, বা যতোই আধার-প্যান লিঙ্কিং হোক না কেন, যতোই প্রধানমন্ত্রী মেট্রো রেলে চড়ে বোঝানোর চেষ্টা করুন না কেন যে জিনিসটা টেকসই, কিছুতেই বন্ধ করা যাবে না বিধায়কের বরের পুরসভার পুরপিতা হওয়া আর ঐ পুরসভারই বিভিন্ন নির্মাণ প্রকল্পের নির্মাতা হওয়া আর সমস্ত প্রয়াস ঝামা পাথর দিয়ে চুঁইয়ে ফুরিয়ে যাওয়া কিংবা একেকটা নিউজ সাইক্লে একেকটা রেপড মেয়ের বিশ্বব্যাপী বিক্রি হয়ে সীমাহীন বিপর্যস্ত হওয়া। 

If you cannot read Bangla, just use the translation app on your device or the translator extension on your internet browser to read it in the language you prefer.

Readers Loved