সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং ………
১৯৮৫-এর সংশোধনী আইনে কিন্তু বিদেশী বলে চিহ্নিত, ১৯৬৬ সালের ১ লা জানুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ -এর মধ্যে ভারতে অনুপ্রবেশকারী, ব্যক্তিদের কাউকে ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হয় নি। বরং বলা হয়েছিল যে তাঁদের নাম নির্বাচক তালিকা থেকে মুছে দেওয়া হবে দশ বছরের জন্য। নাম মোছার আগে তাঁরা নাগরিকত্ব আইনের ধারা ১৮ অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত নিয়মে নিজেদের বিদেশী হিসেবে নথিভুক্ত করাবেন। এইভাবে নথিভুক্ত হওয়ার দশ বছর পরে তাঁরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করে নির্বাচক তালিকায় আবার নিজেদের নাম লেখাতে পারেন। ঐ দশ বছরে তাঁদের ভারতীয় পাসপোর্ট থাকতে পারে, তাঁরা ভারতের মধ্যে বিদেশী হলেও, বিদেশে ভারতীয় হিসেবে পরিচিত হতে পারেন।
২৫ মার্চ ১৯৭১ -এর পরে ভারতে বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশকারীদের ভারতের নাগরিকদের থেকে আলাদা করার চেষ্টায় অসমে ২০১৯ সালে ন্যাশনাল সিটিজেনশিপ রেজিস্টার তৈরি করা হয়। এর ভিত্তি ছিল ১৯৫১-এর নির্বাচক তালিকা এবং পরবর্তী তিনটি নির্বাচক তালিকা যার শেষটি প্রকাশিত হয়েছিল ২৫ শে মার্চ ১৯৭১। এই সব নির্বাচক তালিকাভুক্ত নির্বাচকদের এবং তাঁদের বংশধরদের ভারতের নাগরিক হিসাবে স্বীকার করা হয়। এর ফলে ১৯৬৬ সালের ১ লা জানুয়ারি থেকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ -এর মধ্যে ভারতের অসমে ঢুকে পড়া বেআইনি যে অনুপ্রবেশকারীরা বিদেশী বলে চিহ্নিত হয়ে ছিলেন ১৯৮৫ সালে অসম অ্যাকর্ডে, তাঁরা ১৯৯৫ সালের পরে ন্যাচারালাইজেশনের (ধারা ৬) দ্বারা নাগরিকত্ব অর্জন না করে থাকলে তাঁরা এবং তাঁদের বংশধরেরা ভারতের নাগরিক নন বলেই বিবেচিত হবেন। সে কথা ২০০৯ সালের নাগরিকত্ব নিয়ম (সিটিজেনশিপ রুল, ২০০৩)-এর সংশোধনীতে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তবে অসম অ্যাকর্ডে যেমন স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল যে বিদেশী বলে চিহ্নিত হওয়ার পর বিদেশীদের কী করতে হবে তেমন করে স্পষ্ট কোনো নির্দেশ নাগরিকত্ব নিয়মে নেই। এই বিষয়টি নির্ধারণের ক্ষমতা ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন কেবলমাত্র ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকেই দিয়েছে।
২০১৯-এ অসমের এনআরসি আর সেই বছরের নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী নিয়ে তুলকালাম হয়ে গেলেও,.২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইন সংশোধন নিয়ে কোনও হট্টগোল হয় নি। অথচ এনআরসির শুরু এই ২০০৩ সালের সংশোধনীতেই, সিটিজেন শিপ রুল এবং রাষ্ট্রীয় নাগরিক পঞ্জি ও নাগরিক পরিচয়পত্র প্রণয়নের নির্দেশের মধ্যে দিয়ে। অসম অ্যাকর্ডের মতো স্পষ্ট করে নির্ধারিত না থাকলেও, সিটিজেনশিপ রুল এখনও অনাগরিকদের ভারত থেকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেয় নি।
এছাড়াও একটা সন্দেহের কথা শোনা যায় যে বেছে বেছে মুসলিমদের ভারত থেকে বের করে দেওয়ার জন্যই এনআরসি করার ফিকির। অসমে ২০১৯-এ হয়ে যাওয়ার এনআরসির ফর্ম ছিল সব মিলিয়ে চার পাতার। কোনও পাতাতেই ধর্ম বলার জায়গা ছিল না।
২০১১-এর আদম শুমারির নথিতে গণ্য ব্যাক্তির ধর্ম কী হতে পারে সেটা নানান ধর্মের নামের মধ্যে থেকে বেছে নেওয়ার জায়গায় নাস্তিকতার উল্লেখ ছিল না। তখন নামের ভিত্তিতে ধর্ম নির্ধারণ করা হয়েছে ভারতের বাসিন্দাদের এবং নাস্তিকের সংখ্যা শূণ্য (০) দেখানো হয়েছে। একইভাবে মানুষের নামের ভিত্তিতে তার আচরিত ধর্ম কী তা বুঝে নিয়ে ঐ মানুষদের নাগরিকত্ব খারিজ করতে পারে এনআরসি। কিন্তু তাতে এক একজন সরকারি কর্মীকে দপ্তরের কাজে দৈনিক তিনঘন্টার থেকে অনেক বেশি সময় দিতে হবে। এদিকে সরকারি কর্মীদের পঁচানব্বই শতাংশ শোনা যায় ‘ (খুব অল্প সময়ের জন্য দপ্তরে) যান, আসেন, মাইনে পান’; কাজ করেন না। তাদের সকলকে কোনও বিশেষ শাস্তির জুজু দেখিয়ে যদি কাজে বাধ্যও করা যায়, তাহলেও তাঁরা রাতারাতি দক্ষ হয়ে উঠে মেশিনের মতো নাম দেখে ধর্ম নির্ধারণ করে মানুষের নাগরিকত্ব খারিজ করবেন এতোটা বাস্তবাতীত। তার ওপর থাকবে তাঁদের মগজ নির্গত ব্যক্তিগত (রাজনৈতক আদর্শগত) মতামতের ও বিবেচনার বোঝা।
(চলবে)
লেখা : 2020
প্রকাশ : 2021, 2022
পুরো বই : https://www.amazon.com/dp/B09875SJF8