৪৬. ধার করো
সাকুল্যে চার লাখ টাকা বার করতে পারবে মিন হুয়ে।
প্রথমত, ওর অনেক বন্ধু নেই। বন্ধু যে কজন আছে তাদের মধ্যে মাত্র দু জন মিন হুয়েকে ধার দিতে পারার মতো যথেষ্ট ভালো রোজগার করে আর যাদের সঙ্গে মিন হুয়ের ঘনিষ্ঠতা এমন যে মিন হুয়ে টাকা ধার নিতে পারে। তাঁরা হলেন ঝৌ রু জি আর সাও মু। সাও মুয়ের নিজেরই যথেষ্ট টাকা নেই, আত্মীয়দের থেকে ধার করবেন। তাই মিন হুয়ে গেলো ঝৌ রু জির কাছে।
দু জনে কথা বলে নিলো যে হাসপাতালের পাশে শ্যাংদাও কাফেতে দেখা করবে। মিন হুয়ের মুখটা রুগ্ন, সরাসরি কথা বলতে পারলো না। প্রথমে ও ঝি ঝু কেমন আছে জানতে চাইলো।
“ভালো নয়।”
ঝৌ রু জি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। আমার সাহস হয় নি ওকে বলার। কিন্তু ও খুবই বাধ্য হয়ে উঠেছে, যা বলি তাই করে, খুব সহযোগিতাও করে।”
ওকে ক্লান্ত, রোগা আর কালিমাখা দেখাচ্ছে। মুখের ওপর স্পষ্ট দুটো কালিমাকুন্ডলী জেগে উঠেছে।
মিন হুয়ে সার্জেনের অভিব্যক্তি থেকে পড়ে নিলো, “ভালো নয়” মানে “মৃত্যুর মুখে”।
“তুমি ওকে একলা রেখে আসতে পারছো? আমার এখন তেমন কাজের চাপ নেই। আমি তাহলে রাতে গিয়ে ওর দেখা শোনা করতে পারি।”
“দরকার নেই। ও সৌন্দর্য পছন্দ করে। এখন ওকে ভীষণ ভয়ানক দেখাচ্ছে। আমি চাই না যে তুমি ওকে দেখো এখন। এমনকি এখন নাচের দলের কেউ এলেও ও দেখা করে না।”
“ওর মা, বাবার কী খবর? তুমি কী বলেছো ওঁদেরকে?”
“ওঁরা জানেন। ওঁরা এসেছেন শিংজিয়াং থেকে।”
বললো ঝৌ রু জি, “এখন মূলত ওর মা বাবাই ওর দেখাশোনা করছেন। দুজনেরই স্বাস্থ্য ভালো আছে। দুজনেই সেনাবাহিনীতে ছিলেন। ওঁদের খুবই মন খারাপ, তবে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় খুবই শক্ত দুজনে। খুবই দুঃখের যে ওঁদের মেয়ের কোনো বাচ্চা নেই। না হলে, বৃদ্ধ মানুষটির মতে, উনি আর ওঁর স্ত্রী চোখ বুজলে ওঁদের পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো না।”
ঝৌ রু জি বছরে হাজার হাজার সার্জারি করে। ও ঠাট্টা করে মিন হুয়েকে বলতো যে ওর অধিকাংশ রুগী এক বছরের মধ্যে মারা যাবে, মাত্র কয়েকজন সেরে উঠবে আর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে। যে সব মানুষ রোজ জন্ম আর মৃত্যু দেখেন তাঁরা মৃত্যুর প্রতি একটা মুক্ত মনোভাব রাখেন। এই প্রথম মিন হুয়ে ঝৌ রু জির গলায় কান্নার আভাস পেলো যেনো।
“তোমার খবর কী?” ঝৌ রু জি জানতে চাইলো, “তুমি আর শিন ছি কেমন আছো?”
“বিশেষ কিছু না। এই আর কী।”
“আমার মনে হয় ও এখনো ছন ছনের ব্যাপারে খুবই যত্নশীল।”
“ও ছন ছনকে মেনে নিতে পারে, কিন্তু … ও এখনো আমাকে মেনে নিতে পারে না।”
“সময় নাও যতো খুশি। তোমরা সবাই স্বাস্থ্যবান, সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারো প্রেমে পড়ে।”
বললো ঝৌ রু জি, “অথবা, সারা জীবন কাটিয়ে দিতে পারো ঝগড়া করে।”
ওর গলার স্বরে কেমন যেনো বিষন্নতা ছিলো।
মিন হুয়ে কেবল একটা বাঁকা হাসি হাসতে পারলো।
“যা হোক, তুমি বলছিলে যে আমার সাথে তোমার কী দরকার আছে?”
“না … কিছু না, আমার শুধু তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর ছিলো।” মিন হুয়ে ভেবে ছিলো কথাটা কিন্তু বলতে পারলো না, “ছন ছনের হাসপাতালের দিনগুলোতে এতো যত্ন নিয়ে ছিলে ওর, তাই ধন্যবাদ না বলে পারলাম না।”
“ও তো আমার ছেলে, ওকে নিশ্চয়ই যত্ন করবো।”
ঝৌ রু জি চোখে আরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে বললো, “বলো আর কী আছে?”
“আর কিছু না …”
“আমার কাছে দ্বিধা কিসের? তোমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তুমি খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছো।”
মিন হুয়ের আর কোনো উপায় রইলো না বলা ছাড়া, “রু জি, আমি তোমার থেকে কিছু টাকা ধার চাইতাম।”
মিন হুয়ে হুবহু বললো সাও মুয়ের পরিকল্পনাটা, “আমি বুঝতে পারি নি ঝি ঝুয়ের অসুখ এতো ভয়ানক অবস্থায় গেছে। তোমারও এখন টাকার দরকার। আমি বরং অন্য উপায় দেখি। যদি নিতান্ত না পারি আমি ম্যানেজমেন্ট গ্রুপে আমার জায়গাটা ছেড়ে দেবো।”
“এখন তোমার দরকার কতো?”
মিন হুয়ে খানিক ক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর বললো, “কুড়ি লাখ।”
“আমাদের হাসপাতালের মেডিক্যাল ইন্স্যুরেন্স ভালো। ঝি ঝুয়ের খরচের অধিকাংশটাই পরে পাওয়া যাবে। তাছাড়া ডিভোর্সের সময়ে তুমি কিছুই চাও নি। মনে করো এখন সেই পাওনাটাই পূরণ করে দেবো।”
ঝৌ রু জি খানিক মনে মনে হিসেব করে নিলো, “আমি তোমাকে দশ লাখ দিতে পারব।”
মিন হুয়ে খুব অবাক হয়ে গেলো। ও আশা করে নি যে এতো বেশি টাকা ঝৌ রু জি দিতে চাইবে। ও ধড়ফড় করে বলে উঠলো, “আগে তুমি ঝি ঝুয়ের সাথে কথা বলো।”
“না, এখন আমি ওকে শুধু খুশির খবর শোনাই কয়েকটা। ওর অসুখের জন্য আমি কিছু টাকার বন্দোবস্ত করেছি। আমি ভেবে ছিলাম যে যদি সত্যিই অসম্ভব কিছু হয়, তাহলে আমি ওকে মেগুওয়াতে নিয়ে যাবো, দেখবো যে ওখানকার হাসপাতালগুলো কিছু করতে পারে কিনা। আমি ভাবি নি যে ওর অবস্থা এতো তাড়াতাড়ি খারাপ হয়ে যাবে। এখন ওর শরীর খুবই দূর্বল, ও অতো দূরে যেতে পারবে না এখন। টাকাটা এখন আর আমার কোনো কাজে লাগবে না …”
"কেনো? এর আগে যখন আমি ওকে দেখে ছিলাম, তখন তো বেশ ভালোই দেখাচ্ছিলো। তুমি কী খুব হতাশ হয়ে পড়ছো, রু জি?”
“আমি অনকোলজি বিভাগে কাজ করি। আমি হয়তো কিছু বেশি সংখ্যাতেই দেখেছি এরকম রুগী। আমি পরিস্থিতিটা জানি, জানি রোগটা এখন কোন দশায়। ঝি ঝুয়ের, খুব বেশি হলে, আর দু থেকে তিন মাস আছে।”
***
ঝৌ রু জি কথা রেখেছে। দশ লাখ টাকা ধার দিয়েছে। মেসেজটা যখন মিন হুয়ে পেলো তখন ও ছন ছনকে সঙ্গে নিয়ে, সাও মুয়ের সাথে বেজিং যাচ্ছে ট্রেনে করে।
ট্রেনে চড়ার আগে পাঁচ সদস্যের দলটা একটা মিটিং-এ বসে ছিলো কাজ কতো দূর এগোলো আর লগ্নির পরিস্থিতি কী তাই নিয়ে কথা বলার জন্য। মিন হুয়ে আর হে হাই শিয়াং ছাড়া বাকি তিনজনের লগ্নির টাকার বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। মিন হুয়ে জানিয়েছে যে ওকে এখনো আরো দশ লাখ টাকা জোগাড় করতে হবে আর ও এখনো চেষ্টা করছে টাকাটা পাবার। হে হাই শিয়াং-এর পরিস্থিতিটা আরো বেশি হতাশার। ও জানিয়েছে যে ওর স্ত্রী নাকি বাড়ি বাধা রাখতে রাজি হয় নি। আর ও এখনো খুব চেষ্টা করছে ওর স্ত্রীকে রাজি করানোর জন্য।
“কী? ঝৌ রু জি তোমাকে দশ লাখ য়ুআঁ ধার দিয়েছে?” ট্রেনে যেতে যেতে অবাক হয়ে বললো সাও মু, “আমি আশা করি নি যে তুমি ওর কাছে ধার চাইবে।”
“ও আমার বর ছিলো। আর ওর পরিবারের সবাইও তুলনামূলকভাবে ভালো। তাই আমি সবার আগে ওর কথাই ভেবেছি।” মিন হুয়ে জানতো চাইলো, “এতে এতো অবাক হবার কী আছে?”
“আমি ভাবি নি যে চব্বিশ লাখ টাকা তোমার জন্য সমস্যা হবে না।” বললো সাও মু।
“জিয়ে আমার!” মিন হুয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, “আমি মাত্র কয়েক বছর কাজ করছি এই কটা টাকার জন্য। তাই জমানো অসম্ভব প্রায়।”
“তুমি শিন ছির কছে ধার চাইলে না কেনো?” গলা নামিয়ে সাও মু বললো, “শুনেছি, ও নাকি তোমার ছেলের বাবা।”
মিন হুয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো সাও মুয়ের দিকে, “তুমি জানলে কী করে?”
“ঝৌ রু জি বলেছে।”
“আমি শিন ছির থেকে টাকা ধার করবো না।”
মিন হুয়ে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললো, “ওকে আমি বিশেষ চিনি না।”
“ওকে তুমি বিশেষ চেনো না? তোমাদের বাচ্চা আছে, হ্যাঁ! অবাক হবার কিছুই নেই যে ও তোমাকে নিজে হাতে চিংড়ি মাছ ছাড়িয়ে দিয়েছে।”
সাও মুর বুকের ভেতরে গল্পগুজব আকুলি বিকুলি করে উঠলো, “অ্যাই, তোমরা একে অপরকে চিনলে কী করে?”
“আমি বলতে চাই না।”
মিন ঠোঁট কামড়ে ধরলো, “যাই হোক, আমি ওর থেকে টাকা ধার করবো না।”
“এবারে আমি বেজিং যাচ্ছি কয়েকজন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলার জন্য। শিন ছি তাদের মধ্যে একজন।" বললো সাও মু, “তুমি আমার সঙ্গে এসো না কেনো? তুমি গেলে, হয়তো ও আমাদেরকে প্রচুর টাকা দেবে তোমার জন্য।”
মিন হুয়ে চমকে উঠলো, “তুমি শিন ছির সাথে দেখা করবে?”
“হ্যাঁ করবোই তো। ল্যান নিয়াও জিতুয়াঁ - ব্লু বার্ড গ্রুপ। আমরা বলি বিবিজি। খুব ভালো বিনিয়োগ সংস্থা প্রচুর পুঁজি ওদের। খুব নামডাক। আর ওদের খুব উৎসাহ এআই-তে। উৎসাহী। দং চেং টেকনোলজির এ রাউন্ডে, বিবিজি লগ্নি করেছে দশ কোটি।”
“দং চেং চিকিৎসার যন্ত্রপাতি বানাতো না? ওরা এখন এআই-ও করে?”
“হ্যাঁ। সবাই করছে এখন। পারে না? এখন বলে ‘মেডিক্যাল ইনফরমেসন সলিউশনস্’। কিন্তু আসলে ব্যাপারটা এআই। গত দু বছরে দং চেং টেকনোলজি য়ুআঁলাই-এর সমস্ত ব্যবসা ধরে ফেলেছে। না হলে য়ুআঁলাইয়ের গূজিয়া এমন হুড়মুড়িয়ে পড়তো না। কারণ শিন ছির কোম্পানি।”
“সাও জিয়ে, শিন ছি তো দং চেং টেকনোলজির মালিকানা পেয়েই গেছে, আবার দং চেং টেকনোলজি এআই নিয়েও কাজ করে। তাহলে শিন ছি আর আমাদের কোম্পানিতে পুঁজি লাগাবে?”
“এআই-তে বা’অ্যান অনেক বেশি জোরালো দং চেং টেকনোলজির তুলনায়। ওর জায়গায় আমি থাকলে আমি নিশ্চিতভাবে বা’অ্যান কিনতাম।”
“অনেকগুলো একই প্রজেক্ট থাকবে, একই ডিপার্টমেন্টও থাকবে। তাই না?”
“লে-অফ। ঝামেলা বাদ দাও, কাজ হবে যাদের দিয়ে তাদেরকে রাখো।”
সাও মু আলতো চাপড় দিলেন মিন হুয়ের হাতে, “তোমার যাওয়া উচিৎ আমার সাথে। তুমি আমার পাশে থাকলে, ও যদি কথাও না বলে, তাহলেও আমি ওর ওপরে একটা অদৃশ্য চাপ তৈরি করতে পারবো।”
“আমি যাবো না।”
মিন হুয়ে খুব জোরে জোরে হাত নাড়াল, “আমার সাথে ওর সম্পর্ক ভালো নয়। তুমি হয়তো আমার কথা বলবে, তাতে অবস্থা আরো বিগড়ে যাবে। আমরা কথা বলতে পারবো না।”
“অ্যাই, এটা এরকম কী করে হয়?”
“সোজা কথা, ও খুব বেশি কথা বলে না।”
“ওকে, বুঝতে পারছি আমি, বুঝলাম।” হাসি মুখে বললো সাও মু, “আমি জাল ফেলে বসে থাকি, মাছ ধরার দিকে মন দিয়ে। দুটো ব্যক্তিগত মালিকানার কোম্পানি এর মধ্যেই কথা বলে নিয়েছে। ওরা দেবে চার কোটি করে। এটাই সময় আরেকটা টাকা লগ্নি করার কোম্পানিকে খুঁজে বের করার। বিবিজি আরেকটা কোম্পানি আরো অনেক কোম্পানির মধ্যে।”
“ভালো।" একটা ফাঁকা উত্তর দিলো মিন হুয়ে, “সাও জিয়ে, যেই তুমি কোম্পানির কাজে বাইরে এলে, অমনি শও দি আর শও নিং পুরোপুরি য়িন শু গ্যয়ের হাতে। উনি কী খুব ব্যস্ত?”
“আমি তো বাচ্চাদের খেয়াল রাখি না, যদি কোম্পানির কাজে বাইরে না যাই, তাও। ও-ই তো সব সামলায় সব সময়ে। আমরা একটা ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি না কয়েক দিনের মধ্যে? আমার পরিবার, য়িন শু, খুব সাহায্য করে, সমর্থন করে। ও তো বাড়ির সমস্ত কাজ করে, আমাকে একবারেই মাথা ঘামাতে দেয় না। আমি বলেছি যে আমাকে ব্যবসাটার জন্য নিজের গাঁটের কড়ি দিতে হবে, আর আমার পরিবার কুড়ি লাখ দিতে পারবে, তাও আরো চার লাখ বাকি থাকবে, ও অমনি ওর মা-বাবার কাছে গিয়ে ভীষণ কান্নাকাটি করে পঞ্চাশ লাখ টাকা নিয়ে চলে এলো।”
হাসতে হাসতে সাও মু বললো, “শুরুতে, য়িন শুই জেদ করে ছিলো যে ও আমাকে বিয়ে করবে। কিছুতেই ওর মা মেনে নেন নি। যখন উনি জানতে পেরে ছিলেন যে ওঁকে কিচ্ছু না বলেই আমরা ম্যারেজ সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছি, উনি প্রায় গলায় দড়ি দিয়ে ছিলেন আর কী। বিয়ের অনুষ্ঠানেও আসেন নি। দুটো বাচ্চা হতেও আসেন নি, এখনো আমার সাথে কথা বলেন না। এই কারণে য়িন শুও কয়েক বার ঝগড়া করেছে ওর মা-বাবার সাথে। এভাবে গিয়ে টাকা নিয়ে আসতে ওর নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে, খারাপ লেগেছে।”
প্রত্যেকবার য়িন শুয়ের নাম বলার সময়ে সাও মুর হাবভাবে যদি পাঁচ দাগ অহঙ্কার থাকে তো সাত দাগ থাকে মিষ্টতা। বেশ হিংসে করার মতো। বোঝাই যাচ্ছে যে য়িন শু এখনো ওর অসভ্যতার কথাটা বলে নি সাও মুকে। বা’অ্যানের অবস্থা বেশ সংকটে এখন। মিন হুয়ের অস্থির লাগছে। সময়টা পরিষ্কার। সাও মুকে লাগাতার হাসতে দেখে মিন হুয়ে না পারছে হাসতে, না পারছে কাঁদতে।
***
ট্রেন সকাল দশটায় বেজিং-এ পৌঁছোলো। কনফারেন্সের ব্যবস্থা সামলাচ্ছিলেন যাঁরা তাঁদের কাছে নিজের হাজিরা দেবার পরে, মিন হুয়ে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠালো শিন ছি-কে। জানতে চাইলো ও কখন সু ছনকে নিতে আসবে। ওর সময় থাকলে ও নিজেও দিয়ে আসতে পারে সু ছনকে। ও চাই ছিলো যে ওর ছেলে কয়েক দিন শিন ছির সঙ্গে থাকুক। যাতে ও নিজে কনফারেন্সে মন দিতে পারে আর বাবা আর ছেলে ফের একসাথে থাকতে পারে।
শিন ছি তখনই উত্তর দিলো, “মিটিং-এ আছি। খুব শিগগির এটা শেষ হবে। তুই কোম্পানিতে এলে কেমন হয়? আমরা তারপর দুপুরে একসাথে খেতে পারি।”
একই সঙ্গে ও ঠিকানাও পাঠালো।
ব্লু বার্ডের এশিয়া-প্যসিফিক শাখা দপ্তরটা বেজিং-এর ফিনান্সিয়াল স্ট্রিটের একটা জমকালো বাড়ির আটতলায়।
মিন হুয়ে যেই সু ছনকে নিয়ে এলিভেটর থেকে বেরোলো অমনি ফুলের কড়া সুগন্ধ যেনো আছড়ে পড়লো। হলের মধ্যে একটা বাগান আছে। তাতে অনেক ফুল গাছ, ফুল ফুটে আছে - জিতং, হং ঝাং, য়ুয়েজি, মেইগুই আর জুনঝিল্যান। চারপাশটা রঙীন আর সবুজ। কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মিন হুয়ে চিনতে পারলো হুয়েই ল্যান, গূই বেই ঝু, গুয়াঁয়িঁ আর দূর্দান্ত বেগুনী রঙের ফুলে ভরা একটা লম্বা ক্যাকটাস।
জিতং
|
জুনঝিল্যান |
হুয়েই ল্যান |
গুয়াঁয়িঁ |
দূর্দান্ত বেগুনী রঙের ফুলে ভরা একটা লম্বা ক্যাকটাস |
মাথার ওপরের আলোগুলোর সাথে বাঁ দিকে ঘুরলে একটা অফিস চত্বর এসে পড়ে। অফিস চত্বরে মার্জিত রুচির পরিশীলিত ছাপ।
একজন সুন্দর মহিলা, পরনে স্কার্ট আর কোট, সুগন্ধে ভরা, হাসি মুখে এগিয়ে এলেন, “হ্যালো।”
মিন হুয়ের মুখ দিয়ে যেনো কথা সরে না, “আমি এখানে খুঁজছি … … শিন ছিকে।”
“আপনার পদবী? ওঁর সাথে কী আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?”
“আমার পদবী মিন। আমি ওঁর সাথে যোগাযোগ করে ছিলাম। উনি আমাকে সোজাসুজি চলে আসতে বলেছেন।”
“ওহ্, মিন হুয়ে শওজিয়ে?” বলার সময়ে মেয়েটির কোনো ভান ছিলো না। তার নরম স্বর যেনো কানে পালক বুলিয়ে দিলো, “ইথান, বিশেষ করে নির্দেশ দিয়েছেন। ওঁর মিটিং এখনো শেষ হয়ে যায় নি। কিন্তু খুব শিগগির হয়ে যাবে। আসুন, আপনাকে ওঁর অফিসে নিয়ে যাই। আপনি ওখানেই অপেক্ষা করুন কিছুক্ষণ। আসুন আমার সাথে। বলে রাখি, আমার নাম লি শিন।”
সু ছনকে মিন হুয়ের দু পায়ের ফাঁকে লুকিয়ে থাকতে দেখে, লি শিন হাঁটু মুড়ে বসলো, বললো, “নি হাও, দিদি! আমি লি শিন, তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।”
বলেই ও গম্ভীর মুখে সু ছনের ছোট্টো হাত ধরে করমর্দন করলো।
সু ছন খিলখিল করে হেসে উঠলো। অপ্রস্তুত একটু, চট করে কথা বলতে পারলো না।
“কী মিষ্টি।” হাসলো লি শিন।
মা আর ছেলেকে সে একটা বড়ো অফিসে নিয়ে গেলো। ওদেরকে একটা সোফায় বসতে দিলো।
“কী খাবে তোমরা? কফি, চা, ফলের রস?” আতিথেয়তা করলো লি শিন।
“ধন্যবাদ। কিছুর দরকার নেই।” বললো মিন হুয়ে।
“জিয়ে, আমি কমলালেবুর রস খাব।” জানালো সু ছন।
“ওকে, বোসো এখানে একটু, তোমার জিয়ে নিয়ে আসবে এখনই।” বলে চলে গেলো লি শিন।
অফিসটা বড়ো। হালকা ধূসর রঙের দেওয়াল। দক্ষিণ দিকে একটা কালো ডেস্ক। তারপাশে একটা সাদা সোফা সেট। সাদা কার্পেট।
ডেস্কের একপাশে একটা গোটা দেওয়াল জুড়ে গাছ লাগানো আছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেনো একটা সবুজ পর্দা লাগানো আছে।
সোফা থেকে উঠে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো মিন হুয়ে দেওয়ালটার দিকে। ছুঁয়ে দেখলো হাত দিয়ে। সবুজ মূলো, মাকড়সা গাছ, শীতের জুঁই, ছোট্টো নারকোল গাছ - সব আছে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে, একে অপরের আড়ালে, পুরো জায়গাটাতে ব্যস্ততার বিস্ফোরণ হচ্ছে যেনো।
সবুজ মূলো |
মাকড়সা গাছ |
শীতের জুঁই |
ছোট্টো নারকোল গাছ |
মিন হুয়ে ভাব ছিলো এটাই কী বিখ্যাত ‘ব্রিদিং ওয়াল’?
বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে বিচরণ করা একজন মানুষ হিসেবে খুব স্বাভাবিকভাবেই মিন হুয়ে ভাবতে শুরু করলো আর ওর মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন জেগে উঠলো, এরকম দেওয়ালের গাছে জল কী করে দেওয়া হয়? কী করে এটাকে একই রকম রেখে দেওয়া যায় দিনের পর দিন? কী করে এর মধ্যে দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়া বন্ধ করা যায়? কী করে এটাকে ঠেকনা দেওয়া যায়? কী করে এর থেকে বাষ্প বের করে নেওয়া হয়? কী করে পোকামাকড় আটকানো হয়?
পুরো ভাবনার উদ্যমটা মিন হুয়ের সমস্ত মনোযোগ শুষে নিয়ে ছিলো। যখন মিন হুয়ে আবার তার পারিপার্শ্বিকের সম্বন্ধে সচেতন হলো ততোক্ষণে সু ছন চোখের আড়ালে চলে গেছে।
“ছন ছন?”
মিন হুয়ে ডাক দিলো। কোনো সাড়া নেই। ও দৌড়ে বেরিয়ে এলো অফিসটা থেকে। করিডরের মধ্যে খুঁজে বেড়াতে লাগলো।
খুব দূরে নয়, সু ছন হাঁটতে হাঁটতে কৌতুহল নিয়ে দেখছিলো কাজের জায়গাটার আনাচে-কানাচে নানান গভীরতায়। দুদিকেই নানান অফিস, কাঁচের দেওয়াল পেরিয়ে দেখা যাচ্ছে যে মানুষজন অফিসের ভেতরে বসে কাজ করছেন পাশাপাশি লাগোয়া কাজের কুঠুরির ভেতরে। মিন হুয়ের সাহস হলো না সু ছনকে জোরে ডাকার। তাই ও দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সু ছনের দিকে।
সু ছন যেই দেখলো মিন হুয়ে ওকে ধরে ফেলবে অমনি ও হঠাৎ করে ডান দিকে একটা বাঁক নিলো। অপ্রত্যশিতভাবে ও দৌড়ে গেলো সেই দিকে যেখানে স্যুট পরা, চামড়ার জুতো পরা এক ঝাঁক লোক বেরিয়ে আসছিলো একটা মিটিং ঘর থেকে।
সবাই দেখলো যে একটা বাচ্চা ছেলে লাফাতে লাফাতে দৌড়ে যাচ্ছে, কৌতুহল নিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালো যাতে ওকে রাস্তা করে দেওয়া যায়।
অপ্রস্তুত মিন হুয়ে জানে না যে কী করা যায়। ওর ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিলো দৌড়ে গিয়ে সু ছনকে জাপটে ধরে কিন্তু ও খুব খুশি হয়ে লোকগুলোর একজনে পা জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো, “বাবা! বাবা!”
বছর পঞ্চাশেকের একজন পাকা চুলওয়ালা মানুষ নিচু গলায় কী সব বললেন।
ব্যাখ্যাতীতভাবে শিন ছির একটা ছেলে আছে, এই তথ্যটা শিন ছি নিশ্চয়ই কোম্পানিতে চাউর হতে দিতে চাইবে না। যাই হোক, ওর এখনো বিয়ে হয় নি।
সু ছনকে দেখে শিন ছি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ওকে, ওর মুখে চুমু খেলো, আর খুশির হাসি নিয়ে নিয়ে বললো, “বাবা এখানে। তুমি বাবাকে চাও?”
“হ্যাঁ। বাবা।”
“বোবোবোবো”
পাকা চুলওয়ালা লোকটা হাসলো, বললো, “ইথান, তুমি বিয়ে করলে কবে? আমি জানি না কেনো?”
শিন ছি চোখ পিটপিট করে বললো, “আমি বিয়ে করি নি তো। হঠাৎ জানতে পেরেছি যে আমার একটা ছেলে আছে। দেখো, আমার মতো দেখতে না একদম?”
সেই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো। যদিও ওর মনে অনেক কৌতুহল, তবুও অনেক ক্ষণ সেটাকে দেখানো অস্বস্তিকর। বাকি প্রশ্নগুলো করার সাহসও নেই। তাই ওকে ধীরে ধীরে সরে যেতে হলো।
“উনি -” পাকা চুলওয়ালা লোকটা দেখালো পায়ে পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকা মিন হুয়ের দিকে।
“উনি মিন হুয়ে শওজিয়ে, বা’অ্যান টেকনোলজির আরঅ্যন্ডডি ডিরেক্টর।” হালকা চালে বললো শিন ছি।
“উনি আমার মা।” সংশোধন করে দিলো সু ছন।
“তাও ঠিক।” শিন ছির কোনো উপায় রইলো না মিন হুয়ের সাথে পরিচয় না করিয়ে দিয়ে, “ইনি চেন য়ুআঁ জঁ, বিবিজির চিফ ফিনান্সিয়াল অফিসার।”
“আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।” বললো মিন হুয়ে।
“আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো।” বললেন চেন য়ুআঁ।
এই মূহুর্তে একজন মহিলা বেরিয়ে এলেন কনফারেন্স ঘর থেকে হাতে একগাদা কাগজপত্র নিয়ে। মিন হুয়ে দিকে তাকিয়ে সে একটু অবাক হলো এক মূহুর্তের জন্য। তখুনি চিনতেও পারলো ওকে, “মিন হুয়ে?”
সবুজ হাওয়ার একটা দমক ছেড়ে মিন হুয়ে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইলো কোনো উত্তর না দিয়ে।
শিন ছি ওর সামনের দুই মহিলার দিকে খুব উৎসাহ নিয়ে তাকালো, “আপনারা পরস্পরকে চেনেন?”
“উনি আমার সহকর্মী যিনি হাওয়া বুঝে চলতেন।”
মহিলার চোখগুলো সুন্দর আর তীক্ষ্ণ ফিনিক্সের মতো। তার ভ্রূ দুটো যেনো ঝরে পড়ে উইলো পাতার লেপের টুকরো, শক্তি দিলে দুটো ধারালো তরোয়াল হয়ে উঠবে। তার ঠোঁটদুটো পাতলা। তাড়াতাড়ি উনি বললেন, “আমরা এক বিভাগে কাজ করতাম না।”
“হ্যাঁ” শিন ছি ঘাড় নাড়লো।
“মিন হুয়ে” মহিলা হাত বাড়ালেন বিনয়ের সঙ্গে, “হাউ জো বুজিয়া, কেমন আছো?”
মিন হুয়ে সৌজন্যের দিকে মনই দিলো না, হালকা সুরে শিন ছিকে বললো, “আমি সু ছনকে তোর কাছে রেখে গেলাম। আমি এবার যাবো।”
বলেই ও ঘুরে দাঁড়ালো।
যেতে পারলো না, শিন ছি ওকে চেপে ধরলো, “তাড়া কিসের? খাবার পরে যাবি।”
~~~~~~~~~~~~
সম্পূর্ণ বই বিনামূল্যে : https://dl.bookfunnel.com/lcj5vznt96
Link to Previous Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-45.html
Link to following Post in the Series : https://projectionofnaught.blogspot.com/2024/09/jpda-chapter-47.html