ক্রিসমাসের ডেকরেশন করতে করতে অ্যাশলি বলল, “হলউইনের ডেকরেশনটা এত্তো ভালো ছিল... খুলতেই হবে তাই না?”
নাটালি উত্তর দিল অ্যাশলিকে, “আসছে বছর আবার সাজাব, তবে অন্য রকম। এগুলো সবই মাস খানেক করে থাকে রে... উৎসব তো আর রোজ হয় না।”
এদিকে ইয়ারার কান্না আর থামে না। রোজ সকালে ইস্কুল যেতে কান্না। রোজ রাতে ঘুমোতে গেলে কান্না। জেকব আর নিনা হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে তাকে সামলাতে। কেবল অ্যান্থনি তাকে শান্ত করতে পারে কখনও কখনও।
এসব শুরু হয়েছে অক্টোবরের শেষে দিয়া দে লস মুয়েরতস থেকে। সেদিন পরিবারের সব্বাই মামা কার্লোসের পরিবারের সাথে কার্লোসের বাড়িতে প্রার্থনা করেছিলেন সমস্ত মৃত আত্মীয়-বন্ধুদের স্মৃতিতে। তারপর খাওয়াদাওয়া হয়েছিল।
রেনালদো সেদিনের অনুষ্ঠানে হাজির হননি। ফলে ইয়ারার মনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে বুঝি রেনালদো আর কোনোদিনই আসবেন না। সে আপন মনে বকবক করে খেলার অবসরগুলোতে, যেন সে কথা বলছে রেনালদোর সাথে। অথবা কাউকে কাউকে সে শাসাতে থাকে যে তার বাবা এলেই সে সব বলে দেবে।
পাড়ার সব দরজায় জানলায় হলুইনের সাজ দেখে তার মুখে একটু হাসি ফুটেছিল। কার্টুনের মতো মিষ্টি মিষ্টি দেখতে ভুত সব! দেখলেই নাকি গাল টিপে দিতে ইচ্ছে করে। তার কথা শুনে জেকবও খুব হেসেছিল।
অ্যাশলি তাদের বাসার সদর দরজাটা রঙীন কাগজে মুড়ে দরজায় একটায় লাল রঙের ভেলভেটের মোজা ঝুলিয়ে দিল যেই, অমনি ইয়ারার মুখ হাঁড়ি হয়ে গেল। সব্বার বাড়িতে ভুতের পাট উঠিয়ে প্লাস্টিকের বরফকুচি আর তুলোর বরফের স্তুপ দেখা দিয়েছে। সব্বার বাড়ি সেজে উঠেছে আলোয়। শুধু তাদেরই সেই যেমনকে তেমন, আলুথালু রান্নাঘর, খাবার ঘর, বসারঘর আর জবরজং জিনিস ভর্তি বারান্দা। এবার তার বায়না, “আমারও দরজায় একটা লাল মোজা চাই, স্যান্টা না হলে আমার জন্য প্যারাশুট আনলে আমাকে দেবে কী করে?”
এসব বলার সময় তার গলাটা বুজে আসে। সে কথাগুলো বলে কোনো রকমে হেঁচকি তুলে তুলে, আর তার দুচোখ বেয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে থাকে।
একদিন চার্চ থেকে কয়েকজন মহিলা এসে বাড়ির সবার জন্য জামা দিলেন। জামা, গরমজামা, মোজা জুতো সবই ছিল। কিন্তু ইয়ারা নিজের প্যাকেটের নতুন জিনিস ফেলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল, “আ-আ-ম্মার জামা চাই না-আ-আ, আম্-মার ট্র্যাম-, ট্র্যা-ম – পো-ও লি-ই-ন চাই-ইইই একটাআআআ।”
তার কদিন পরে একটু সময় বার করে একটা সাদা কাগজের প্লেটে রঙ পেন্সিল দিয়ে, আর কাটা কাগজ দিয়ে নিনা একটা স্নোম্যান বানিয়ে দিল ইয়ারাকে। ইয়ারা খুব খুশি হয়ে সেটা ঝুলিয়ে দিল দরজায়। ঝোলাবার জন্য তাকে জেকব একটা লাল রিবন এনে দিল কোথা থেকে কে জানে।
তারপর একদিন ইয়ারা ঘুম থেকে উঠে দেখল যে চিকচিকে লাল কাগজে বানানো একটা মোজা ঝোলানো আছে দরজায়। মোজাটা দেখে সে জড়িয়ে ধরল মারিয়াকে, আদুরে গলায় বলল, “বলো, বাবা আসবে ক্রিসমাসে তাই না? আসবেই আসবে...”
মারিয়া ইয়ারাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললেন, “আমি জানি না।”
ক্রিসমাসের আগের দিন মারিয়া সারাদিন রান্না করলেন মার্সেলার সাথে। তারপর নিনা, অ্যান্থনি, হেক্টর, এমনকি জেকব আর ইয়ারাও ছুটে ছুটে গাড়িতে জিনিস ভরল সন্ধেবেলা। ইয়ারাদের অ্যাপার্টমেন্টের ওপরতলার ভারতীয় ভদ্রলোক আর তাঁর সঙ্গিনীর সাথে জেকব আর ইয়ারার দেখা হয়ে গেল পার্কিং-এ। গাড়িগুলো পাশাপাশি থাকে কিনা।
প্রতিবেশীরা জেকব আর আর ইয়ারাকে ক্রিসমাসে শুভেচ্ছা জানালেন। ওরাও প্রত্যুত্তরে শুভেচ্ছা জানাল। উত্তেজনায় টগবগ করতে করতে বলে ফেলল, “আজ বাবা আসছে মেহিকো থেকে জানো তো! মেহিকো থেকে আরও অনেকে আসবে অলিভিয়া মাসির বাড়িতে। তাই আমরা ওখানে যাচ্ছি!”
নিনা এসে পড়ে কথোপকথনের খানিকটা শুনতে পেয়েছিল। তাছাড়া প্রতিবেশিনীর সাথে তার কথোপকথন চলে, মায়েরও চলে। তাই সে বলল, “আমাদের বাড়িতে তো ক্রিসমাস ট্রি নেই, অলিভিয়া মাসিদের বাড়িতে আছে। তাই আমরা ওখানে যাব ক্রিসমাস পালন করতে। ওখানে আমাদের অন্যান্য আত্মীয়রাও আসবে। খুব মজা হবে।”
নিনার উপছে ওঠা খুশিটাও বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে সে ইয়ারা কিংবা জেকবের থেকে বয়স্ক হলেও, এখনও বড়োদের দলে পড়ে না। আর সে বার বার জেকব আর ইয়ারাকে বলছিল, “গাড়িতে উঠে বোসো। এত বকবক করছিলে দুজনে! মা শুনতে পেলে কী হতো?”
ক্রিসমাস ইভে মিগেইল বাড়ি এলেন।
অ্যাশলি এতো দিন পরে, তায় উৎসবের দিনে মিগেইলকে পেয়ে আর ছাড়তেই চায় না। সে আসলে বুঝে উঠতে পারে না কার থেকে বকেয়া আদরটা নেবে বেশি করে। প্রিসিলার থেকে নাকি মিগেইলের থেকে।
মিগেইল প্রিসিলার জন্য খুব খুশি। খুশি এডউইন আর নাটালির জন্যও। সব্বার পড়াশোনার, কাজের আর ভবিষ্যত পরিকল্পনার গল্পের মাঝে মাঝে উপছে আসছিল আগেকার বছরগুলোতে উৎসব উদ্যাপণের স্মৃতি। সবার মনেই অনেক অনিশ্চয়তার স্রোত। তবু ন্যাট বলল, “আমরা আবার আগের মতোই ক্রিসমাস ট্রি লাগাবো ঘরে। কিচ্ছু ভেবো না তুমি।”
পরেরদিন দুপুরে টেরেসা এসে জুটলেন। কথায় কথায় উঠলো বেঞ্জামিন মাইলসের ভিডিওর কথা। তাতে খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন মিগেইল। কিন্তু ভেরোনিকা খুব ভরসা দিলেন সক্কলকে, “জানো তোমরা, ওই ভিডিওটার জন্যই মিগেইল জানতে পারে যে বেঞ্জামিন এ পাড়াতেই থাকে! ওদের সাথেই জেলে আছে সে। মায়ের অসুখ বলে, নিজের অসুখ বলে বেরোয় জেল থেকে মাঝে মাঝেই। আর সময়ে ফেরে না। তাই তো অমন হেলিকপ্টার আসে।”
তারপর মিগেইল নিজেই স্বাভাবিক হয়ে বললেন, “বেঞ্জামিনের সঙ্গীসাথীদের থেকে শুনেছি যে ও জেলের বাইরে থাকলে কোভিনা প্লাজাতে রবার্টসন্সের ওয়্যার হাউসে কাজ করে। আমি কোনো দিনই রবার্টসন্সের ওয়্যার হাউসে ডেলিভারি করি নি।”
মিগেইল একটু থামলেন। এসব কথার মাথামুন্ডু না বুঝে অ্যাশলি নিজের খেলার মধ্যে মেতে গেছে। বাকিরা সব্বাই রুদ্ধশ্বাসে শুনছে।
মিগেইল বলে চললেন, “বেঞ্জামিনের ওখানে কাজ করার কারণ রবার্টসন্সের ট্রাকের ফেরিতে করে ওর নিজের ব্যবসার মাল দেওয়া নেওয়া করা। ওর ব্যবসাটা হলো চোরাই নিষিদ্ধ রাসায়নিকের, মাদকের। বেঞ্জামিন ট্রাক থেকে মাল নামানোর কাজই বেশি করে রবার্টসন্সের ওয়্যার হাউসে। ফলে নিজের জিনিসটা রবার্টসন্সের মালের ভেতর থেকে বার করে নিতে ওর অসুবিধে হয় না। ওর মেক্সিকান যোগানদারেরা রবার্টসন্সের ট্রাকে ওর বায়না করা চোরাই নিষিদ্ধ রাসায়নিক ভরে দেয়। যে ট্রাকে সাধারণত ওরা এগুলো ভরে, সেগুলো হাইওয়ে দিয়ে আসে না। আসে মাঠ আর জলা পেরিয়ে, কাস্টমস্ আর বর্ডার পেট্রোলের চেকপোস্ট এড়িয়ে।”
টেরেসা আশঙ্কায় শিউরে উঠলেন, “কী সাঙ্ঘাতিক কথা! পুরো সীমানা জুড়ে তো আর কাস্টমস্ পোস্ট বানানো যায় না। আবার বর্ডারর সব বিন্দুতে বিন্দুতে সারাক্ষণ পেট্রোল কারও থাকে না। সুতরাং পেট্রোল কারের রাউন্ডের সময় এড়িয়ে মেক্সিকোর সীমানা পেরিয়ে আমেরিকায় ঢুকে পড়ে এরা নিশ্চয়ই......”
ভেরোনিকা বললেন, “সে সব আর আমরা জানব কোথা থেকে!”
নাটালি জানাল, “ইউটিউব থেকে।”
প্রিসিলা কৌতুহল গোপণ করতে পারল না, “ইউটিউবে এসব ভিডিও কারা আপলোড করে?”
এডউইন ফোড়ন কাটল, “অপরাধীরা নিজেরাই করে নিশ্চয়ই ওস্তাদি ফলাতে।”
খোঁচাটা গায়ে না মেখে নাটালি জানাল, “আমি ভক্স বা ভাইস বা ওরকম কোনো নিউজ এজেন্সির চ্যানেলে দেখেছি। কয়েকটা ইংরেজিতে, কয়েকটা এস্প্যানিয়লে।”
মিগেইল বললেন, “এখন তোমরা কত কী নিজেরাই ইন্টারনেট থেকে জেনে নিতে পারো। আমি যদি জানতাম তাহলে এমন বিপদে পড়তাম না।”
ভেরোনিকা বললেন, “ফোনে তোলা ভিডিও আর ইন্টারনেটের জন্যই তো আমরা এতো কথা জানতে পারলাম। শুধু তাই বা কেনো... প্রযুক্তির জন্যই তো বিচার ব্যবস্থাও মানুষের সাক্ষ্য প্রমাণের থেকেও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে মানুষের যে স্বতঃস্ফুর্ত আচরণ ক্যামেরায় ধরা পড়ছে বা সোস্যাল মিডিয়ায় ফুটে উঠছে সেই সবকে।”
ভেরোনিকার মতামত কিভাবে মিগেইলের বলা বেঞ্জমিনের ব্যপারের সঙ্গে মেলে সেটা প্রিসিলা বা এডউইন বুঝতে পারেনি। এডউইন জিজ্ঞেস করল, “মানে?”
প্রিসিলা বলে উঠল, “বেঞ্জামিনের কারবার বা বাবার পরিস্থিতির সাথে বিচার ব্যবস্থা আধুনিক প্রযুক্তিকে কিভাবে কাজে লাগাচ্ছে তার কী সম্পর্ক?”
ভেরোনিকা বললেন, “আছে সম্পর্ক। আগে মিগেইল বেঞ্জামিনের সম্বন্ধে যা বলছিল বলে নিক। তারপর আমি বলব।”
এটা বলেই তিনি আর কাউকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অনুরোধ করলেন, “বলো মিগেইল, জেলে তুমি বেঞ্জামিনের কথা যা শুনেছ.........”
মিগেইল শুরু করলেন, “বেঞ্জামিনের বন্ধুরা মনে করে যে বেঞ্জামিন বেশ চালাক। সে যা করে সেটা সে খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করে। আর সে কাজে সে খুবই দক্ষ। তারা বেঞ্জামিনের ওস্তাদির গল্প বলে বেশ বীরগাথা বলার মতো করে। তাদের গল্প-গাছার থেকেই কানে এসেছিলো যে বেঞ্জামিন ব্যবসা বাড়ানোর জন্য নতুন যোগানদারের সাথে কাজ শুরু করেছিল। সেই যোগানদার রবার্টসন্সের ট্রাক চেনে না। ফলে যে ট্রাকে সে নিষিদ্ধ রাসায়নিক চোরাচালানের জন্য ভরেছিল সীমানা পেরোনোর ট্রাকের লাইনে, সেই ট্রাক চেকপোস্টে ধরা পড়ে। বেঞ্জামিনের কনসাইনমেন্ট সরকারী হেফাজতে জমা পড়ে। ওর প্রচুর টাকার ক্ষতি হয়। তাই তো ওকে বারবার জেল থেকে বেরোনোর ফিকির করতে হচ্ছে ...... তাড়াতাড়ি ক্ষতিপূরণ করে পাওনাদারদের সন্তুষ্ট করতে হবে যে।”
এডউইন বলল, “বুঝত পারছি, মানে আন্দাজ করতে পারছি, কিন্তু......”
প্রিসিলা গভীর মনোযোগী গলায় বলল, “ভাবছিলাম এসব কথা তুমিই বা জানলে কী করে বাবা! তার মানে তুমি ওদের কানাকানি শুনেছ।”
নাটালি গলায় জমাট দলাটাকে গিলতে গিলতে বলল, “কিন্তু এসব প্রমাণ করা যাবে না, তাই তো?”
টেরেসা সাবধানী গলায় বললেন, “না, হানি, যাবে না। বেঞ্জামিনকে দিয়ে কোর্টে এসব কবুল করানোর কি মাশুল দিতে হবে আমরা তা জানি না। তাছাড়া ওদের কাছেও প্রমাণ নেই যে তোমার বাবার ট্রাকেই ওদের জিনিস আসছিল। তারওপর এসব নিয়ে ওর সাথে বেশি আলোচনা করলে ও তোমাদের বাবাকে কাজে বহাল করার চেষ্টা করতে পারে, মানে, বাবাকে ওদের দলে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। ওদের দলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ওদের কথা এতটা জেনে গেছে যে মিগেইল সেটা ওরা জানতে পারলে আমরা সব্বাই বিপদে পড়তে পারি। তাই আমরা বেঞ্জামিনের সাথে কোনো লেনদেন করব না।”
মিগেইল বললেন, “সরকার কেসদুটোকে জুড়ে সাজালে তবে সম্ভাবনা আছে যে আমি যে নির্দোষ সে কথা প্রমাণ হওয়ার। কিন্তু এখনও সরকার পক্ষ এসব কথা জানে বলে মনে হয় না। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম আমার উকিলকে আমি চিঠি লিখে জানাব এসব। ভেরোনিকার সাথে পরামর্শ করে দেখলাম যে সে ভারি বিপজ্জনক ব্যাপার। কথাটা কোনোভাবে বেঞ্জামিনের দল তাদের নিজের নিজের উকিল মারফৎ জানতে পারলে আমরা সবাই বিপদে পড়ব। আমার উকিল যদি এসব জানান ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, ফেডেরাল অ্যাটর্নি আর সব সরকারী কৌঁসুলির দপ্তরে, যারা এই মামলার বাদী পক্ষ, তাতে তদন্ত করতে হবে আন্তর্জাতিক সীমা পেরিয়ে। যে লোকটি ভুল ট্রাকে বেঞ্জামিনের বেআইনি মাল তুলেছিল তাকে দিয়ে কবুল করাতে হবে যে সে ভুল ট্রাকে বেঞ্জামিনের মাল তুলেছে। তারওপর তাকে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। খুঁজে পেলেও সে নিজের ভুল স্বীকার করবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই......।”
নাটালি জানতে চাইল, “তাহলে বেঞ্জামিন জেলে গেছে কী অন্য কোনো অপরাধে?”
ভেরোনিকা উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ। প্রাথমিক ভাবে একটা নাইন-ওয়ান-ওয়ান কলে পুলিশ নালিশ পায় যে ও নাকি ওর মায়ের ওপর অত্যাচার করছে। তার তদন্তে এসে দেখে যে ওর অ্যাপার্টমেন্টে নানা রকম মাদকের আর নিষিদ্ধ রাসায়নিকের ব্যবসা চলছে। এই দুটো অপরাধের তদন্তের সাথে আমাদের কেসের কোনো যোগাযোগ নেই। তাছাড়া আমাদের শুনানি চুকে গেছে। মিগেইল আগে কখনও কোনও বেআইনি কাজ করে নি। কোনো কারণে জেলেও যায় নি। যে জিনিসটা মিগেইলের ট্রাকে পাওয়া গেছে সেই জিনিসটার সাথে যে পয়সা-কড়ির লেনদেন চলেছে তার সঙ্গে মিগেইলের কোনো যোগাযোগ ছিল এমনটাও প্রমাণ করা যায় নি। তাই নিঃসন্দেহভাবে মিগেইলকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় নি। তবে নিজের ট্রাকে না জেনে নিষিদ্ধ মাদক বওয়াটাও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বলে ধরা হয়েছে। তাই কিছুদিনের হাজতবাস হলো আর কি। একটু ভুলের জন্য, অপরাধীর মতো সাজা ..... তাও নয়। শুধু একটা বিপজ্জনক ব্যবস্থার খপ্পরে পড়ে গেছে মিগেইল.....”
এডউইন জানতে চাইল, “আর ট্রাকটা?”
মিগেইল বললেন, “ওটা আর পাওয়া যাবে না বোধ হয়। ওটা তো মামলার প্রমাণ। ওটার জেরে হয়তো মাদক আর অন্যান্য নিষিদ্ধ রাসায়নিকের চোরাচালানে জড়িত অপরাধীদের ধরার চেষ্টা করবে সরকার। আমিও আর নিজের ট্রাকে মাল বইব না। কোনো কনভেনিয়েন্স স্টোর বা গ্রসারি চেনে ড্রাইভারের কাজ নেব। নিজের ট্রাকটার পুরো লগ্নিটা গেল তো...... আর এতোদিন বিনা রোজগারে থাকার পর, ট্রাক কেনার ক্ষমতাও নেই আমার। তাছাড়া কোম্পানির বাধা চাকরিতে ঝুঁকি কম। শুধু ইউনাইটেড স্টেটস্-এর মধ্যেই মাল ফেরির কাজ করব ...... আমার ছোট্টো ভুলে এতো বড় অপরাধের শাস্তি ......। আমি আসলে ক্রেটের মধ্যের জিনিস তো আর ঘেঁটে দেখি না। সেটা আমার কাজ নয় বলেই এতোদিন জানতাম......”
সব্বাই চুপচাপ হয়ে যেতে ভেরোনিকা বললেন, “নাটালি আর অ্যাশলি যেদিন প্রথম হেলিকপ্টারের কথা বলেছিল আমাদের সেদিন অ্যাশলির জ্বর হয়েছিল। মনে আছে তোমাদের?”
টেরেসা বললেন, “মনে আছে হেলিকপ্টারের জন্য। নাহলে জ্বর তো অ্যাশলির থেকেই থেকেই হয়...”
ভেরোনিকা নিজের কথায় ফিরলেন আবার, “সেদিন আমি থাকতে পারি নি। জরুরী মিটিং-এর জন্য। নাটালি ছিল অ্যাশলির দেখাশোনায়।”
এডউইন গলায় সমবেদনা মিশিয়ে মনে করাল সবাইকে, “আমি না জানি কিনা কী বলেছিলাম নাটালিকে, হেলিকপ্টারের ব্যাপারে......”
ভেরোনিকা কথার সূত্র টেনে নিলেন, “সেই মিটিং-টা ছিল সরকারী কৌঁসুলিদের সাথে। তাঁরা জানিয়েছিলেন যে মিগেইলের নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সে সম্ভাবনার কারণ জেলে কিছু আসামীর কথোপকথন, যেটা তাঁদের শক্তিশালী ক্যামেরায় ভিডিও রেকর্ডিং হয়েছে। সে জন্য ওঁরা আমাকে এটাও বলেন যে মিগেইলের সঙ্গে দেখা করার সময় আমি যেন জানতে চাই যে জেলের মধ্যে মিগেইল কিছু শুনেছে কিনা। এর ফলে মিগেইল অন্য আসামীদের কথা চালাচালি শুনতে শুরুর করবে, সে সব আমাকে বলতে শুরু করবে। আমি সে সব রেকর্ড করে ওঁদের জানাতে থাকব...”
মিগেইল বলে উঠলেন, “তুমি যে বলতে ছেলেমেয়েদের শোনাবে আমাদের কথা, আমার গলার স্বর; তাই রেকর্ড করছ!”
ভেরোনিকা বললেন, “না হলে তুমি ভয় পেতে পারতে।। জেলের ভিতর তোমার বিপদের কথা, জেলের বাইরে আমাদের বিপদের কথা ভেবে......”
টেরেসা উৎসুক হয়ে জানতে চাইলেন, “তুমি কী সেসব সরকারী কৌঁসুলিদের দিয়েছ?”
ভেরোনিকা শান্ত গলায় বললেন, “দিয়েছি। তার থেকেই ওঁরা ঠাহর করতে পেরেছেন যে কোন কোন আসামীদের নিজেদের কারবারের মধ্যে যোগাযোগ আছে। সেই সব আসামীদের প্রত্যেক মূহুর্তের কথোপকথন, আচার- আচরণ, লেনদেন বিশেষভাবে ভিডিওতে রেকর্ড করা হয়েছে জেলের ভেতরের নানান ক্যামেরায়। এমনকি লুকোনো ক্যামেরা দিয়েও। তার থেকেই ওঁরা দিন তারিখ, সময় মিলিয়ে প্রমাণ পেয়েছেন যে মিগেইলের ট্রাকে নিষিদ্ধ মাদক ভরা হয়েছিল মিগেইলের অজান্তে। সীমান্তের ওপারের আইন রক্ষার অব্যবস্থার জন্যই মিগেইল নিজের অজান্তে অপরাধী হয়ে গেছেন।”
এই অবধি বলে সবার, এমনকি মিগেইলেরও হতবাক চেহারার দেখে তাকিয়ে ভেরোনিকার ঠোঁটে হাসির একটা আভাস খেলে গেল। খানিকটা খুশিতে। খানিকটা সক্কলকে নিশ্চিন্ত করতে পারার তুষ্টিতে।
তারপর তিনি আবার বলতে লাগলেন, “এখন ট্রাক ড্রাইভারদের সচেতন করা হচ্ছে যে তাঁরা যেন ইলেকট্রনিক তালা লাগান কন্টেনারে, যাতে কোনোভাবে কন্টেনারে চোরাই মাল ভরতে গেলে অ্যালার্ম বাজে ড্রাইভারকে সচেতন করার জন্য। ড্যাশক্যাম দিয়ে যেমন ট্রাকের সামনের সব পরিস্থিতি ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়, তেমনই কন্টেনারে রিয়ার ভিউ, ইনার ভিউ ক্যামেরা দিয়ে নজরদারির ব্যবস্থা করতে বলা হচ্ছে। আর সীমান্তের যেখানে পাকা রাস্তা নেই, চেকপোস্ট নেই, সেসব জায়গা দিয়ে যেহেতু ট্রাক পেরোতে পারে সেহেতু সেসব জায়গাতে ড্রোন দিয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।”
নাটালি আবার তার অধৈর্য কৌতুহলে লাগাম পরিয়ে প্রশ্ন করল, “তাহলে কী প্রমাণ হলো বাবা নির্দোষ?”
ভেরোনিকা বললেন, “হ্যাঁ হলো তো। নতুন বছরে জুরিদের সামনে আবার পুরো ব্যাপারটা পেশ করা হবে। সঙ্গে অনুরোধ থাকবে মিগেইলকে সসম্মানে মুক্তি দেওয়ার জন্য।”
প্রিসিলা তর্ক জুড়ল, “জুরিরা বাবাকে নির্দোষ না মানলে বাবাকে হাজতবাস করতে হবে?”
ভেরোনিকা বললেন, “সে সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। সরকারী কৌঁসুলিরা শুরুর থেকে আন্দাজ করেছিলেন যে তোমাদের বাবা একটা আইনি অব্যবস্থার শিকার। তাঁরা সন্তোষজনক প্রমাণও জোগাড় করেছেন। তাঁদের যেমন দায় অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা, তেমনই নিরপরাধ যেন শাস্তি না পায় সেইটা নিশ্চিত করাও তাঁদের শপথ নেওয়া কর্তব্যের একটা। তাই সরকার মিগেইলের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা খারিজের দরখাস্ত করবে। তাতে জুরির মত যাই হোক, বিচারক মিগেইলকে মুক্তি দিতে পারবেন।”
সব্বার মুখে একসাথে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠল। প্রিসিলা এডউইনকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, “ইয়ে...”
নাটালি ভেরোনিকার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলতে লাগল, “থ্যাংক ইউ মা, ইউ আর দ্য বেস্ট।”
টেরেসা মিগেইলের হাত ধরে নিজের দুই তালুতে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কন্গ্রাচুলেসনস।”
মিগেইল ভেরোনিকার দিকে হাসি মুখে ছলছল চোখে তাকিয়ে বললেন, “তুমি আমাকে বাঁচালে।”
খুশির আবহাওয়া আঁচ করে অ্যাশলি মিগেইলের কোলের ওপর ঝাঁপিয়ে এসে বলল, “আমরা কি মুভি দেখব এবার?”
উত্তর দিলেন টেরেসা, “চলো সব্বাই সিনেমা দেখি। আমি অনেকগুলো ডিভিডি এনেছি।”~~~~~~~~~~~~~